খুনিদের ভয় ছিল বিমানবন্দরের পথে তাঁদের গুলি করে মারা হবে

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের সময়ে যাহিদ হোসেন ছিলেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক। ৪ নভেম্বর পর্যন্ত দাপ্তরিক কাজে তাঁকে নিয়মিত বঙ্গভবনে যেতে হয়েছে। তিনি সেই তিন মাসের ঘটনার নীরব সাক্ষী। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন অজানা বহু কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

যাহিদ হোসেন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপনি কোন দায়িত্বে ছিলেন? বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা কখন জানতে পারলেন?

যাহিদ হোসেন: আমি আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের (আইএসপিআর) পরিচালক পদে ছিলাম। আমাদের অফিস ছিল পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে। জনসংযোগ বিভাগে তখন সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। আমি ছাড়া সেখানে একজন উপপরিচালক আর চারজন সহকারী পরিচালক ছিলেন। সবাই বেসামরিক ব্যক্তি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ১৫ আগস্ট যে ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আপনারা কি তেমন কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন? কিছু শুনেছিলেন?

যাহিদ হোসেন: সে সময় জাসদ নেতা মেজর (অব.) আবদুল জলিল আর কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের সমর্থকেরা গণবাহিনী গঠন করেছেন। সেনানিবাসের ভেতরেও গণবাহিনী তৎপর ছিল। আমার কাছে এ সম্পর্কে কিছু কিছু খবর আসত। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ছিলেন কর্নেল জামিল। তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের খবর প্রথম কখন পেলেন?

যাহিদ হোসেন: আমার বাসা তখন ছিল সেনানিবাসের ভেতরে। আমার এক আত্মীয় থাকতেন ধানমন্ডিতে। ভোর পাঁচটায় টেলিফোন করে তিনি বললেন, গোলাগুলি হচ্ছে। আমি তখনই আমার বন্ধু ঢাকার এসপি মাহবুবউদ্দিন আহমদকে ফোন করি। তিনিও জানালেন, গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন। এর কিছুক্ষণ পর বেতারে মেজর ডালিমের ঘোষণা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার ছোটবেলার বন্ধু মেজর মকবুল হায়দার ডিজিএফআই অফিসে কর্মরত ছিলেন। তিনি আমার বাসায় এলেন সন্ধ্যা ছয়টায়। ওর কাছে শুনলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কীভাবে সবার লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। সেদিনই প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হককে ফোন করি। তিনি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘বাসায় থেকো।’ পরে অফিস খুললে অফিসে যাই। ১৮ আগস্ট ডেপুটি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় গেলাম। জিয়ার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জাতির জনককে কেন রক্ষা করতে পারলেন না? জবাবে জিয়া বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাও আছেন। এরপর তিনি ড্রয়িংরুমের উল্টো দিকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গিয়ে দেয়ালে টাঙানো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, আমাকে অতটা অকৃতজ্ঞ ভাববেন না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার কারও সঙ্গে আপনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল?

যাহিদ হোসেন: ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান হলেন। প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হক নির্দেশ দিলেন, আমি যেন আইএসপিআরের প্রথা অনুযায়ী সেনাপ্রধানের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত গণমাধ্যমে পাঠাই। প্রয়োজনে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে বললেন। তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, ‘ঘটনা ঘটেছে ৯ দিন। আপনার তো চেহারা দেখলাম না।’ আমার কিছু বলার ছিল না। পরে তিনি রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে লাল টেলিফোনে কথা বলেন এবং আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আদেশ দেন। ওসমানী বসতেন বঙ্গভবনে। তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি সেনাপ্রধানের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত দেখে অনুমোদন করে দিলেন। সেই সঙ্গে এ কথাও বললেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়া যেন সামরিক বাহিনী-সংক্রান্ত কোনো খবর গণমাধ্যমে দেওয়া না হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে পরে কি আপনার দেখা হয়েছে?

যাহিদ হোসেন: ওসমানী সপ্তাহে দু-তিন দিন ঢাকার বাইরের সেনানিবাস পরিদর্শনে যেতেন। আইএসপিআর থেকে আমাকেও থাকতে হতো। একদিনের কথা মনে পড়ে। জেনারেল ওসমানী চট্টগ্রামে যাবেন। সেনাপ্রধান জিয়া ছাড়া সবাই ঠিক সময়ে হেলিকপ্টারে এসে বসেছেন। ওসমানী এ কে খন্দকারকে নির্দেশ দিলেন হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করতে। তিনি ইতস্তত করছিলেন। মিনিট পাঁচেক পর আবার হুকুম দিলেন। তখনই সেনাপ্রধানের গাড়ি আসতে দেখা যাচ্ছিল। তিনি এসে তঁার আসনে বসলেন। তখনই জেনারেল ওসমানী সবার সামনেই জিয়ার উদ্দেশে বললেন, বি পাংচুয়াল অ্যান্ড কাম অলওয়েজ ইন টাইম।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে কারও সঙ্গে আপনার সরাসরি কথা হয়েছে?

যাহিদ হোসেন: আমি প্রতিদিনই বঙ্গভবনে যেতাম। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মাসরুকুল হকের কক্ষে বসতাম। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বঙ্গভবনে থাকতেন বলে তাঁদের সেখানে দেখতাম। ট্যাংক রেজিমেন্টের কর্মকর্তা আহমদ শরফুল হোসেন ছিলেন আমার সহপাঠী। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ১৫ আগস্ট ভোররাতে তাঁরা যখন রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, তখন খুব ভয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের ট্যাংকে তো গোলা নেই। ওরা গুলি করলে আমরা শেষ।’

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান হলো। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। সেই সময়ের কোনো ঘটনা আপনার মনে আছে কি?

যাহিদ হোসেন: ৩ নভেম্বর প্রায় সারা দিনই সামরিক সচিবের অফিসে ছিলাম। খালেদ মোশাররফ আর তঁার অনুসারীরা সেনানিবাসের দখল নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন। তাঁরা নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ দাবি করেন। দেশের বাইরে থাকার জন্য তাঁরা বড় অঙ্কের অর্থও চাইলেন। খুনিদের পক্ষে ওসমানী আলোচনা করছিলেন। ৪ নভেম্বর আমি সামরিক সচিবের কক্ষে বসে আছি। এ সময় নতুন সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ সেখানে এলে আমি তঁাকে অভিনন্দন জানাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসুন। আমার ওখানেই নাশতা করবেন।’ ৫ তারিখ সকালে তাঁর বাসায় গেলাম। নাশতা করার সময় হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান এলেন। তাঁকে দেখে খালেদ মোশাররফ বললেন, ‘যাহিদ সাহেব, পরে কথা হবে।’ সেই কথা আর হয়নি। ৭ তারিখে তিনি পাল্টা অভ্যুত্থানকারীদের হাতে নিহত হন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ৩ নভেম্বরের আর কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে?

যাহিদ হোসেন: হ্যাঁ, একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমি সামরিক সচিবের রুমে বসে আছি। এ সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক ও রশিদ দুজনই বিধ্বস্ত অবস্থায় সেখানে এলেন। সামরিক সচিবকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, খালেদ মোশাররফের লোকেরা নাকি গাড়িতে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? সামরিক সচিব তখনই কাউকে টেলিফোন করলেন। অপর প্রান্তে কে ছিলেন জানি না। তবে কথা বলার পর তিনি ফারুক-রশিদকে আশ্বস্ত করে বললেন, তঁারা নিরাপদে দেশের বাইরে যেতে পারবেন। আসলে খালেদ মোশাররফ রক্তপাত চাননি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কখনো দেখা হয়েছে?

যাহিদ হোসেন: বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে ঢাকা সেনানিবাসে গিয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ যেখানে হয়েছিল, মূলত সেই জায়গাটি দেখতে। তঁার সঙ্গে তখন সেনাপ্রধান মোহাম্মদ সফিউল্লাহ, উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং চিফ অব স্টাফ খালেদ মোশাররফও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেনানিবাস পরিদর্শনের ছবি আর প্রেস রিলিজ পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব হাশেম সাহেব আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। ’৫৪ সালের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের ঘটনার স্মরণ করে বললেন, ‘তুই সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র। আমরা এসেছি তোদের কাছে। তুই আইএসপিআর থেকে ছবি ও প্রেস রিলিজ পাঠাবি।’

১৯৭৪ সালে চোরাচালানবিরোধী সমন্বিত অভিযানের সময় প্রতিদিন গণভবনে যেতাম। কোথায় কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে, কী কী মাল জব্দ হয়েছে—
বঙ্গবন্ধু জানতে চাইতেন। আমি আগেই নোট করে নিতাম। তাঁকে সংক্ষেপে বলতাম। স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর যে সান্নিধ্য পেয়েছি, তা আমার জীবনে অত্যন্ত স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

যাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।