রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই আসতে হবে

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য বিরোধ চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা মনে করে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। বিএনপি ও এর সহযাত্রীদের মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হতে হবে। এ বিরোধের মীমাংসা কী, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানরাফসান গালিব

ড. মাহবুবউল্লাহ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমরা অনেক সংকটের মধ্যে আছি, তার মধ্যে একটি হচ্ছে নির্বাচন। কীভাবে দেখছেন?

মাহবুবউল্লাহ: বাংলাদেশের এ মুহূর্তের সংকট হচ্ছে একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এমন যুগপৎ সংকটের সমাধান করা আসলে কঠিন হয়ে যায়। আমাদের এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, এ রকম খারাপ অবস্থা কিন্তু অতীতে কখনো ছিল না। এটি ঠিক, বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনকে ম্যানিপুলেট করার জন্য কায়দাকানুন করা হয়েছে। কিন্তু সেটি এখনকার মতো অতটা তীব্র ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সংকট উত্তরণে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনাও হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিএনপিও কি আলোচনায় উৎসাহী নয়?

মাহবুবউল্লাহ: সরকার কথা বলতে চাইলে তো নিশ্চয়ই তারা কথা বলবে। কিন্তু উদ্যোগটা তো প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসতে হবে। অতীতেও এমন উদ্যোগ ছিল, তাতে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরনের উদাহরণই কিন্তু আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে দাওয়াত দিলেন এবং কথাও দিলেন—নির্বাচনে সরকার থেকে কোনো প্রভাব বিস্তার করা হবে না। কিন্তু দিনের নির্বাচনটা রাতে হলো। আমার কাছে আশ্চর্যজনক হচ্ছে, এ রকম করে নির্বাচন করেও সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকল। এরপরও জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ আছে, যা আমরা ব্যক্তিগত আলাপে অনেকের মধ্যেই দেখি, কিন্তু সেটি সমষ্টিগত ক্ষোভ হিসেবে প্রকাশ হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর বিরোধী দল থেকেও কোনো কর্মসূচি দেখা গেল না।

মাহবুবউল্লাহ: হ্যাঁ, তারা কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করেনি। একটা সভা-সমাবেশ করেও সেটি হতে পারত। হতে পারে, তাদের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে যে শত শত মামলার কথা বলা হয় বা গুম-খুনের কথা বলা হয়, সেসব বিবেচনা করে তারা তাৎক্ষণিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচন–পরবর্তী যে ধাক্কা, সেটি সামলে উঠতে পারেনি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আগামী নির্বাচন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মাহবুবউল্লাহ: স্বাধীনতা–পরবর্তী ৫১ বছরে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা যায়, কখনোই কিন্তু এখানে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। কাছাকাছি অবস্থায় গিয়েছিল, ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১–এর নির্বাচন। আমি এর মধ্যে ২০০৮–এর নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত করছি না সংগত কারণে। যাঁরা সে সময় ক্ষমতাসীন ছিলেন, যে বাঘের পিঠে চড়েছেন, সেখান থেকে নিরাপদে নামার জন্য তাদের একটা তাড়া ছিল এবং তাঁদের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করা হবে না। ভারতের সে সময়ের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বইয়ে সেসব আছে, সালমান খুরশিদের বইয়েও কিছু কিছু আছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এমনটি প্রকাশ পেয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি করারই কথা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এখন বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এতে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী নাকি দুর্বল হবে?

মাহবুবউল্লাহ: তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করেও দেখেছে, না করেও দেখেছে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা মারাত্মক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ন্যূনতম ন্যায়বোধ আছে এমন মানুষের কাছে বিরোধী দলের দাবির বিষয়টি অযৌক্তিক নয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বলেই তো ’৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল। এখন তারাই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বাতিল করে দিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কেমন হতে পারে?

মাহবুবউল্লাহ: এমন সংকটের সময়, সংকট যাতে তীব্র না হয় বা সমাধান তৈরি হয়, সিভিল সোসাইটি এগিয়ে আসে। অতীতেও তাদের ভূমিকা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এখন সিভিল সোসাইটির শক্তি এতই ম্রিয়মাণ, তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। আর নানা সময়ে অনেককেই হারানোর কারণে সিভিল সোসাইটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যক্তিরও এখানে ঘাটতি আছে। এরশাদের সময় আমরা দেখেছি ৩১ বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি। সেটি সে সময়ের রাজনীতিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। মানুষের মধ্যেও এই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছিল। সে রকম ৩১ জন মানুষ কি এখন বাংলাদেশে নেই; শুধু বিবেকের তাড়নায় মানুষের জন্য, দেশের সংকট সমাধানের জন্য যাঁরা কিছু কথা বলবেন? থাকলে নিঃসন্দেহে পারস্পরিক যোগাযোগটা শুরু হতো। তেমন তো কিছু দেখছি না। আগামী নির্বাচনের জন্য এখন বেশ কিছু সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় সমঝোতা দরকার। এর জন্য সিভিল সোসাইটির বড় ভূমিকা প্রয়োজন। তারা সামর্থ্যহীন হলেও আমাদের একেবারে আশাহীন হওয়া তো উচিত নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যার যার অবস্থানে অনড়। এ পরিস্থিতি কি সংঘাতে রূপ নেবে?

মাহবুবউল্লাহ: সংঘাত হয়তো হবে না। সেই ধরনের প্রবণতাও এখন পর্যন্ত আমি দেখি না। কারণ, বিএনপি আন্তরিকভাবেই সংঘাতের দিকে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে না। তাদের সে রকম সাংগঠনিক শক্তিও নেই। সে কারণে তারা সংঘাতের ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে বিএনপি কি শেষমেশ সরকারের অধীনে বা শর্তে নির্বাচনে যেতে রাজি হবে?

মাহবুবউল্লাহ: সেটিও আমার মনে হয় না। তারা তো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এমন কোনো দিন নেই বিএনপির মহাসচিব বলছেন না, তাঁরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। এরপর যদি ডিগবাজি খেয়ে সরকারের শর্তে রাজি হন, তাহলে মানুষের কাছে তাঁরা রাজনৈতিক আস্থা হারাবেন। সরকারকেও বিষয়টি বুঝতে হবে। তাঁরা তো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেন, সেটি নৈতিকভাবে শুদ্ধও ছিল না। কিন্তু মানুষও এমন বড় আন্দোলন করেনি যে তাকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়। শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রশ্ন, আর কত? এবার অন্তত তারা নমনীয় হোক। মাঝেমধ্যে দেখি, বিরোধী দলকে বাধা না দেওয়া বা গ্রেপ্তার না করার কথা বলে তারা। এরপরও তো কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা এ বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: গত দুটি নির্বাচন কমিশন নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে দেখছেন?

মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তো আমাদের দেশে প্রথামাফিক হয়ে গেছে। পার্থক্য বলতে উনিশ আর বিশ। অনেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে আগের দুই কমিশন থেকে ভালো বলছেন। তারপরও বর্তমান সিইসির যেসব কথাবার্তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হয়, তিনি ভালো হোমওয়ার্ক করে কথাবার্তা বলছেন না। মানুষের ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের জন্য তাঁকে সেটি করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

মাহবুবউল্লাহ: দেখেন, দুই পক্ষের অবস্থানের কথাই বললাম। এখন কে কীভাবে ছাড় দেয়, সেটির ওপর সবকিছু নির্ভর করে। এখানে নানা ধরনের ফর্মুলার কথা আসবে। ধরেন, ১৯৯৫ সালে স্যার নিনিয়ান উভয় পক্ষের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি থেকে মন্ত্রী নেওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি মনে করি, এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে জন–অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, সেটি দীর্ঘায়িতও হতে পারে; যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আন্দোলনে রূপ নেওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ক্ষমতায় থাকতে কতটা সুবিধাজনক মনে করবে, সেটিও তখন দেখার বিষয় হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।