অর্থনীতির ক্ষতি কাটাতে ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যাবে

  • সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্তত ১০ বছর ধরে সংস্কার সাধন করতে হবে। এতে সরকারের আন্তরিক ও দৃঢ় সমর্থন থাকতে হবে।

  • বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে বটে, কিন্তু এর ভিত্তি এত দুর্বল যে কখনো বড় ধরনের অভিঘাত এলে সেটা সহ্য করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।

আকবর আলি খান
লেখক ও চিন্তক আকবর আলি খান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন। চলমান কোভিড-১৯ মোকাবিলা, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক অবস্থা, ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি; দুর্নীতি, সুশাসনসহ আরও নানা বিষয়ে তিনি সম্প্রতি টেলিফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রশ্ন :

কোভিড মহামারি চলছে পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে। মোটের ওপর অবরুদ্ধ দশা। এই অবস্থায় আপনি কেমন আছেন?

আকবর আলি খান: জুলাই মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম। অবশ্য আমার উপসর্গগুলোর মাত্রা ছিল নিচের দিকে। মাসখানেক চিকিৎসার পর এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। যাঁরা আমার জন্য দোয়া করেছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা জানাই।

প্রশ্ন :

অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত আপনি নিশ্চয়ই বাসাতেই ছিলেন?

আকবর আলি খান: আগাগোড়া বাসাতেই ছিলাম। কারণ, করোনার ভয়ে বাইরে যাওয়ার সাহস পাইনি। বাংলাদেশে সংক্রমণ যখন শুরু হয়েছে, তখন থেকেই আমি বাসায় আছি। এক দিনের জন্যও বাসার বাইরে যাইনি।

প্রশ্ন :

আপনার সময় কাটছে কীভাবে? একঘেয়ে লাগছে কি না?

আকবর আলি খান: আমি টেলিভিশন দেখি, বই পড়ি ও গান শুনি। এই করে সময় কাটাতে হচ্ছে। আর কিছু করার উপায় নেই। আর টেলিফোনে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথাবার্তা বলি; আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিই।

প্রশ্ন :

কিছু কি লিখছেন এখন?

আকবর আলি খান: আমি দুটো বই লেখার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। একটি বাজেট সম্পর্কে, আরেকটি বই হলো আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড। দুটি বইয়ের জন্যই অনেক কাগজপত্র জোগাড় হয়েছে। এখন আমি লেখা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছি। দেখা যাক, আগামী ফেব্রুয়ারিতে দুটোর মধ্যে অন্তত একটা বই বের করা যাবে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর এখন এ দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি আপনি কেমন দেখছেন? স্বাস্থ্যগত দিক থেকে আমরা কী অবস্থায় আছি এবং স্বাস্থ্য খাত কী অবস্থার দিকে যাচ্ছে?

আকবর আলি খান: স্বাস্থ্যগত দিক থেকে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। একটা হতে পারে যে সংক্রমণ উচ্চপর্যায়ে উঠে ধীরে ধীরে নেমে আসতে পারে। কিন্তু নেমে না-ও আসতে পারে, কিংবা নামলেও তাতে কত সময় লেগে যেতে পারে, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অবশ্যই উন্নতি হবে। তবে সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ইত্যাদি যে নিয়মগুলোর কথা বারবার বলা হচ্ছে, এগুলো সবাই পালন করলে আমাদের এখানে কোভিডের প্রকোপ কমে যেতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই এটা কমে যাবে, এ রকম মনে করার কোনো কারণ আমি দেখছি না।

প্রশ্ন :

এটা গেল স্বাস্থ্যগত দিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের কী অবস্থা? আমাদের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?

আকবর আলি খান: কোভিড-১৯ অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। এটা শুরু হওয়ার আগে প্রকাশিত দারিদ্র্যের অর্থনীতি নিয়ে এক বইতে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে বটে, কিন্তু এর ভিত্তি এত দুর্বল যে কখনো বড় ধরনের অভিঘাত এলে সেটা সহ্য করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। আমি তিনটি অভিঘাতের কথা বলেছিলাম। একটা হলো, যদি আমাদের রপ্তানি কমে যায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো বিপর্যয় আসে, তাহলে সেটার আঘাত সামলানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। দুই নম্বর হলো, আমাদের যেসব মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন, যদি কোনো কারণে তাঁদের দেশে ফিরে আসতে হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হবে, সেটা মোকাবিলা করার মতো সামর্থ্যও আমাদের নেই। তিন নম্বর হলো, কৃষি খাতে যদি কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়, তাহলে সেটাও সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। কোভিড মহামারির কারণে এই তিন খাতের মধ্যে দুটিতে বিপর্যয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে এবং সেবা খাত থেকে আমাদের স্থূল জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) সিংহভাগ আসে, কোভিডের কারণে সেবা খাতের আয় অনেক কমে গেছে। ফলে আমাদের অর্থনীতি বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছে।

প্রশ্ন :

কবে, কীভাবে এই বিপদ কাটবে?

আকবর আলি খান: অনেকে বলছেন, কোভিডের কারণে আমাদের অর্থনীতি সে সমস্যায় পড়েছে, তা সাময়িক। আমরা যেভাবে চট করে নেমে গেছি, সেভাবেই আবার ঝট করে উঠে যাব। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা সীমিত বলে আমার মনে হয়। অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন :

সেটা কাটিয়ে ওঠা কি আমাদের অর্থনীতির নিজস্ব শক্তির বলেই সম্ভব হবে? নাকি সরকারকে এর জন্য বিশেষ কোনো নীতিকৌশল নিতে হবে?

আকবর আলি খান: এখানে সরকারের অবশ্যই ভূমিকা আছে। নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু উচ্ছ্বাসের ভিত্তিতে সেই নীতি প্রণয়ন করলে হবে না; জনসাধারণকে খুশি করতে বক্তৃতা দিয়ে, টাকা ছাপিয়ে হবে না। প্রতিটি পয়সা যাতে সঠিকভাবে খরচ হয়, জনগণের সম্পদ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে হলে সুশাসনের প্রয়োজন হবে।

প্রশ্ন :

সুশাসনের প্রসঙ্গ যখন এল, তখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, কোভিড মোকাবিলার এই পুরো সময়টায় সুশাসনের কী অবস্থা দেখা গেল? সরকারের কার্যক্রম আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আকবর আলি খান: সরকারের পক্ষ থেকে যেসব নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো ঠিকই আছে। কিন্তু সমস্যা যেটা হয়েছে, যে নীতি নির্ধারিত হয়েছে, সেটা বাস্তবায়িত হয়নি এবং বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা বাংলাদেশের অত্যন্ত সীমিত। কারণ, নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য যে সুশাসন প্রয়োজন, বাংলাদেশে সেই সুশাসনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। তার ফলে নীতি সঠিক হলেও সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না এবং বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে আমাদের সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে।

প্রশ্ন :

কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। হাসপাতালের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে; কোভিড হাসপাতালগুলোর ৭০ শতাংশের বেশি শয্যা খালি থাকছে; সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভীষণ সমস্যা হয়েছে। নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগও এসেছে। এসব বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

আকবর আলি খান: স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা শিক্ষাব্যবস্থা শুধু এই কোভিডের জন্য ভেঙে পড়েনি। অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি যখন অর্থসচিব ছিলাম, সেই সময় দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাতে কোনো সুশাসন নেই। বিদেশি দাতারা বলল, ‘তোমাদের স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না বলে সংকট বিরাজ করছে।’ আমি বললাম, অর্থ সঠিকভাবে খরচ করার সামর্থ্য তাদের নেই। তারা বলল, ‘তুমি অর্থ বরাদ্দ দাও, তারপর আমরা দেখব।’ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলো; তারপর দেখা গেল বাজারে যে জিনিসের দাম ১০০ টাকা, সেই জিনিস কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৪ হাজার টাকা—এ নিয়ে জাতীয় সংসদে শুনানি হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে, আর সেই তদন্তের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। তো এই হলো আমাদের সুশাসনের অবস্থা, সে-ও আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে। এই দুই যুগে সুশাসনের আরও অনেক অবনতি ঘটেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্তত ১০ বছর ধরে সংস্কার সাধন করতে হবে এবং সেই সংস্কারের পেছনে সরকারের আন্তরিক ও দৃঢ় সমর্থন থাকতে হবে।

প্রশ্ন :

একসময় তো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন অনেক সুপারিশও পেশ করেছিল। কিন্তু সংস্কার হলো না কেন?

আকবর আলি খান: জনপ্রশাসন সংস্কার হয়নি। কারণ, সরকার সংস্কার করতে চায় না। সে জন্য সংস্কারের পথে আমাদের যাওয়া হয়নি। শুধু বর্তমান সরকার নয়, এর আগের সরকার, তারও আগের সরকার, অতীতে কখনো কোনো সরকারই কোনো সংস্কার করেনি, করতে চায়নি।

প্রশ্ন :

সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ বিকশিত হয়, উন্নত ও মজবুত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টোটাই হচ্ছে। ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই আরও দুর্বল ও বিশৃঙ্খল হচ্ছে। কেন?

আকবর আলি খান: প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানবিক উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ। মানব-সংস্কার করা না গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার করা, তার উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। আমার একটি বই আছে গ্রেশামস ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড নামে। গ্রেশামস ল হলো এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে কম মূল্যের ধাতু বেশি মূল্যের ধাতুর চেয়ে বাজারে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এই গ্রেশামস ল বিরাজ করছে আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায়। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু আমরা তা করিনি।

প্রশ্ন :

মানব-সংস্কার কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। এটা করার উপায়গুলো কী?

আকবর আলি খান: নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন; সরকারি কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা পরিবর্তনসহ অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন। এ দেশে মেধার মূল্য দেওয়া হয় না; এই ব্যবস্থায় কম মেধার কর্মকর্তারা ওপরের দিকে উঠে যায়। এটা বদলাতে হবে, মেধার মূল্য দিতে হবে। শুধু চাকরিতে ঢোকার সময় নয়, যারা চাকরিতে আছে, তাদেরও মেধার মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে যে এসিআর ব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করা হয়, তাতে প্রায় ৯০ শতাংশ অসাধারণ দক্ষ বলে মূল্যায়িত হয়। এতসংখ্যক কর্মকর্তা যদি সত্যিই অসাধারণ দক্ষ হতেন, তাহলে আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এ রকম হতো না।

প্রশ্ন :

আমাদের এই স্বাধীন, সার্বভৌম, আধুনিক ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবস্থা হয়েছে এমন যে তারা কর দিয়ে সরকার-প্রশাসনসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র চালু রাখে, কিন্তু তাদের করের অর্থ কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, সেই জবাবদিহি তারা চাইতে পারে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?

আকবর আলি খান: আপনার বক্তব্য সঠিক। আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু শুধু সেটাই যথেষ্ট নয়, সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। আমি নিরাশাবাদী নই। আমি আশা করি, পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, একপর্যায়ে আমরা এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাব, যাঁরা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কাজ করবেন। এগুলো মানবিক সমস্যা, মানুষের পক্ষে এগুলোর সমাধান করা সম্ভব। অন্য অনেক দেশ করতে পেরেছে, আমরাও পারব।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আকবর আলি খান: ধন্যবাদ।