আক্রোশের শিকার সাংবাদিকেরা

গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? রাষ্ট্রের নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, এসব প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলনে। এ নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খান–এর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।

মসিউর রহমান খান
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সংবিধান নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও মতপ্রকাশ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে সরকারের মধ্যে বাধা আসলে কারা?

মসিউর রহমান: সরকার নীতিগতভাবে সাংবাদিকবান্ধব। তবে এর পরও বহু ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা বেশি করছেন। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করায় বা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণে সরকার নির্দেশ দিয়ে এসব মামলা করাচ্ছে, এমনটা মনে করি না। তবে এটি বলা যায়, স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের যেসব ঘটনা ঘটছে বা মামলা হচ্ছে, তার ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। সাংবাদিকদের ওপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধেও সরকার কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে সরকার সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার কথা বললেও এটি অনেক ক্ষেত্রে শুধু ‘মুখের কথা’ হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলনে ‘সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত’, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড ভাঙার চেষ্টা’, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে’—এই তিন বিষয় বারবার এসেছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

মসিউর রহমান: প্রথমেই বলতে চাই, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর সচিবালয়ের মতো জায়গায় একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, এ রকম ঘটনা এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে। এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের বাধা পেরিয়ে একজন সাংবাদিককে প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথি সংগ্রহ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো সাংবাদিকের জীবন ও পেশা—দুটোই হুমকির মুখে পড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে নির্যাতনের পর শত বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে মামলা দিয়ে সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এর প্রভাব সাংবাদিকতার ওপর পড়বেই। আগে কেউ সেভাবে বিবেচনায় না নিলেও এটি এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংবাদিকতার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই অবস্থায় সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আইন থাকা জরুরি। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মী আইনও করতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সুশাসনের অভাব, গণতান্ত্রিক চর্চায় ঘাটতির কারণেও কি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে?

মসিউর রহমান: যখন যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তারা নিজেদের মতো করে সুশাসনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। আবার এটাও দেখা যায়, ক্ষমতাসীনদের অনেকেই সাংবাদিকদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করেন। এর কারণ, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতি করেন, সাংবাদিকেরা সেটি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। সাংবাদিকদের লেখার মাধ্যমে সুশাসনের অনুপস্থিতির বিষয়টি প্রকাশ পায়। সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরলেও অনেকে ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা তখন সাংবাদিকদের ওপর চাপ তৈরি করতে চান। এর প্রভাব গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর পড়ে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও, এমনকি ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরির অপচেষ্টা চলছে বলে মনে করেন কি? এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। কী বলবেন?

মসিউর রহমান: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এতটাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে যে কোনটি ঠিক আর কোনটি ঠিক নয়, সেটিও সেখানকার কর্মকর্তারা হয়তো বুঝতে পারছেন না। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত একটি মন্ত্রণালয় কী করে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ভুল, অসত্য, খণ্ডিত ও বিকৃত তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, সেটি বিস্ময়কর। আর এখন ফেসবুকে তারা ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকারের দায়িত্বশীল কিছু ব্যক্তিও ফেসবুকে খণ্ডিত ভিডিও ও বক্তব্য প্রচার করছেন। এটি স্পষ্টভাবেই আইনের লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের টাকা ব্যবহার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা অফিশিয়াল ফেসবুকসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার বাদী মামলা হওয়া উচিত।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করাসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাবানেরা সাংবাদিকদের প্রতি একধরনের আক্রোশমূলক মনোভাব পোষণ করেন, এর কারণ কী?

মসিউর রহমান: কিছু অসৎ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মনে করেন সাংবাদিকেরাই তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা। অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও যাতে জবাবদিহির মুখে পড়তে না হয়, সে জন্য কিছু আমলা নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষমতাকে কার্যত অকার্যকর করে রেখেছেন। তাঁরা মনে করেন, সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে অপকর্ম করেও পার পাওয়া যাবে। ফলে তাঁদের আক্রোশের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। রোজিনা ইসলামের ঘটনায় বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। অথচ সরকারের নৈতিক অবস্থান হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহিষ্ণুতা) দেখানো। সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে চাইলে সরকারের উচিত হবে আইনি বিধিনিষেধ আরোপ নয়, বরং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা।