‘আমাদের উপলব্ধি করার কোনো ইচ্ছা কী তাদের আছে?’

স্বাধীনতার পর বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশে আসেন পাকিস্তানের দুই সাংবাদিক মাজহার আলী খান ও সৈয়দ নজিউল্লাহ। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ। পরে বিশেষ কারণে বঙ্গবন্ধুর জন্য লিখিত প্রশ্ন জমা দিয়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন তাঁরা। বঙ্গবন্ধুর লিখিত জবাব ১৯৭২ সালের অক্টোবর ডন-এ ছাপা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি কোনো সাংবাদিককে শেখ মুজিবুর রহমানের এটাই সম্ভবত একমাত্র সাক্ষাৎকার।

মাজহার আলী খান ও সৈয়দ নজিউল্লাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

মাজহার আলী খান পাকিস্তানের সংবাদপত্রজগতের অন্যতম সেরা এক সম্পাদক। ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। তরুণ বয়সে এই পারিবারিক জমিদারির বিরুদ্ধেই কৃষকদের সংগঠিত করা শুরু করেন। পরে পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ নেতা মিয়া ইফতেখারউদ্দিন তাঁকে দ্য পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদকীয় বিভাগে টেনে নেন। চার বছরের মাথায় রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ গ্রেপ্তার হলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মাজহার আলী খান। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব কর্তৃক দখল নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনিই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। তাঁর এই আট বছরের সম্পাদনাকালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আরোহণ করে পাকিস্তান টাইমস, অর্থনৈতিকভাবেও হয়ে ওঠে স্বনির্ভর। তখন পত্রিকাটি ছিল সমাজের এমন এক কণ্ঠস্বর, যাকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদেরও ছিল না। পাকিস্তান টাইমসকে একটি স্বাধীন পত্রিকা হিসেবে দাঁড় করানোই মাজহারের প্রধান সাফল্য। নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকার পরও শুধু সম্পাদকীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে কোনো রাজনৈতিক দলেই যোগ দেননি মাজহার। মালিক একটি দলের সমর্থক হলেও পত্রিকায় তাঁর নীতির প্রতিফলন ঘটাতে দেননি।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার আলতাফ গওহরকে কারাগারে নিক্ষেপ করলে অল্প সময়ের জন্য ডন-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়েছিলেন মাজহার। এই সময়ই শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিতে ঢাকায় আসেন মাজহার, সঙ্গে ছিলেন আরেক সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ নজিউল্লাহ।

সত্তরের দশকের সংবাদপত্র পাঠকের কাছে সৈয়দ নজিউল্লাহও অপরিচিত কোনো নাম নয়, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান অবজারভার-এ নিয়মিত লিখতেন তিনি। ইসলামাবাদের বাঙালিরা তাঁকে নিজেদের মুখপাত্র মনে করত। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লেখার মতো বুকের পাটা পশ্চিম পাকিস্তানে তখন খুব কম সাংবাদিকেরই ছিল। এই আইয়ুবের কড়া সমালোচক ছিলেন নজিউল্লাহ। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আইয়ুবের কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর এই সমালোচনার ধারা ইয়াহিয়া আমলেও অব্যাহত থাকে। বাঙালি শামসুল হুদার মালিকানাধীন সাপ্তাহিক ইন্টারউইংয়ে ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের সমালোচনা করে আর্টিকেল লেখায় তাঁকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন একটি সামরিক আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশেই প্রতিবাদ হয়, সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী জীবনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠেন নজিউল্লাহ। তাঁর অর্থনীতিবিষয়ক বক্তৃতাগুলো নাকি তিনিই লিখে দিতেন।

বাংলাদেশের জন্মের পর এই দুই সাংবাদিক অন্তত কনফেডারেশন আকারে হলেও দেশটাকে পাকিস্তানের সঙ্গে রেখে দেওয়ার শেষ চেষ্টা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চান ভুট্টোর কাছে। ভারত হয়ে তাঁদের বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দেন ভুট্টো। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উভয়ের সঙ্গেই মাজহার-নজিউল্লাহর ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে ভারতের ভেতর দিয়ে ভ্রমণের অনুমতি জোগাড় করাও কষ্টকর হলো না। আর বিশেষ অনুমতিপত্র ইস্যু করে তাঁদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের এই সফরের গোপন উদ্দেশ্যের কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন কি না, জানা যায় না, খুব সম্ভবত তিনি জানতেন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতেই আসছেন তাঁরা। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকার তাঁদের এমন এক সময় এই অনুমতি প্রদান করে, যখন কেউ কাউকে স্বীকৃতি দেয়নি।

পাকিস্তানি দুই সাংবাদিকের ঢাকায় অবস্থানকালে ইসলামাবাদে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাওলানা কাওসার নিয়াজি এক বিবৃতিতে বলে বসেন, শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে ঢাকায় গেছেন মাজহার-নজিউল্লাহ। তাঁর এই মন্তব্য ঢাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা ত্যাগের আগপর্যন্ত তাঁদের একরকম গৃহবন্দী করে রাখা হয়। যা-ই বলা হবে, সব অফ দ্য রেকর্ড থাকবে—এই আশ্বাস দেওয়ার পরও তাঁদের আর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন লিখিত প্রশ্ন জমা দিয়েই ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন তাঁরা। বঙ্গবন্ধুর লিখিত জবাব পরে নয়াদিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের অক্টোবর ডন-এ সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি কোনো সাংবাদিককে শেখ মুজিবুর রহমানের এই প্রথম এবং আমাদের জানামতে শেষ সাক্ষাৎকার।

নজিউল্লাহকে দেওয়া অনুমতিপত্র

প্রশ্ন: আপনার মতে, আমাদের দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রাথমিক রূপ কী ধরনের হওয়া উচিত? এটা কি উপমহাদেশের জনসাধারণকে সহায়তা করবে, বিশ্বশান্তির অগ্রগতি হবে?
উত্তর: প্রথমে উপমহাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। সামনের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য আমাদের পেছনে তাকানো বন্ধ করতে হবে। সার্বভৌম সমতা এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা—এই ভিত্তির ওপর একে অপরে কাজ করলে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারে।

প্রশ্ন: আমাদের মনে হয়, অচলাবস্থা সত্ত্বেও বর্তমানে উভয় পক্ষ অনেক কাছে এসেছে, ফারাকটাও কমে এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে সমস্যাটি এখন পদ্ধতি ও কৌশলের প্রশ্নে এসে ঠেকেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অন্তরায়, বিভিন্ন সময়ে সাধারণের কাছে উভয় পক্ষের করা অঙ্গীকার—সবই তো আপনাদের জানা—এসব বিবেচনায় নিয়ে আপনি কি একটা উপায় বাতলাতে পারেন?
উত্তর: অবশ্যই পারি। উপমহাদেশে সমগ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থেই আমি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে বিশ্বাসী। এত কিছুর পরও আমাদের জনগণ মূলত উদার আছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সব বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগকে তারা স্বাগত জানাবে। এখন প্রয়োজন উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা। এমন আন্তরিকতা যদি থাকে—আপনাকে আমি বলতে পারি, আমাদের তরফে আন্তরিকতার অভাব নেই—আলোচনার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না।

প্রশ্ন: আশা করি, এ কথা আপনি উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারের মানবিক সমস্যা সমাধানে অবশ্যই কিছু একটা করা উচিত।
উত্তর: বাংলাদেশের মানুষের মতো দুঃখ-দুর্ভোগ আর কোনো মানুষ ভোগ করেনি। তাই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই বলে যে মানবিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমরাই বিশেষভাবে উদ্‌গ্রীব, তা সে ভুক্তভোগী পরিবার বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তান—যেখানেরই হোক। পাকিস্তানের জনগণের এত দিনে উপলব্ধি করা উচিত যে এমন কোনো মানবিক সমস্যা নেই, যা আমাদের অজানা। এসব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সমতার ভিত্তিতে এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের প্রতিবেশী ভারতও আন্তরিকভাবে আগ্রহী বলে মনে করার মতো কারণ আমার রয়েছে।

প্রশ্ন: পাকিস্তানে আমাদের বাঙালি ভাই, যাঁরা বাংলাদেশে কাজ করার অপশন নিয়েছেন, তাঁদের মনে ভুল ধারণা আছে। আজ হোক, কাল হোক, এখানে ফিরে আসার পর কোনো চাকরির প্রত্যাশা আদৌ তাঁরা করতে পারেন কি না। সাধারণ ধারণা এই যে তাঁরা আর এখানে বাঞ্ছিত নন। কোনো মন্তব্য করবেন?
উত্তর: এমন ভুল ধারণা থাকা উচিত নয়। এমন ভুল ধারণা সৃষ্টিতে পাকিস্তানি প্রচারণা সফল হবে না। আমাদের জনগণকে আমি জানি, তারাও আমাদের জানে। স্বদেশে ফিরতে আগ্রহী প্রত্যেক বাঙালির জন্য বাংলাদেশে জায়গা আছে। আপনারা হয়তো জানেন যে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের পোষ্যদের আমরা খোরাকি ভাতা দিচ্ছি। বাঙালি ভাইদের জন্য আপনাদের উৎকণ্ঠায় আমি কৃতজ্ঞ কিন্তু আমি ভাবছি, আপনাদের সরকার বা আপনাদের স্বদেশবাসীও কি এই উদ্বেগের ভাগীদার? তাদের জীবন ধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত করে, তাদের স্বদেশে ফিরতে না দিয়ে তাঁরা এই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, কী আশ্চর্য! এ এক অদ্ভুত ভ্রাতৃ-উদ্বেগ, যেখানে তাদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে, পশুপালের মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জড়ো করা হয়েছে এবং আরও নানা উপায়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

প্রশ্ন: পদ্ধতিগত জট একবার অপসারিত হয়ে গেলে এবং সবকিছু কাজ করা শুরু করলে আমাদের দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠবে—এমনটা কি আপনি দেখতে পান? আর তা যদি হয়, তবে উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সম্পর্কটাকে আপনি কেমনভাবে দেখেন?
উত্তর: এখানেই আপনার সঙ্গে আমার দ্বিমত। কোনো পদ্ধতিগত জট নেই। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতেই কেবল অর্থপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে—সাধারণ এই বিষয়টাই শুধু মেনে নেওয়ার প্রশ্ন। একবার আলোচনা শুরু হলে আমাদের সব সমস্যা সমাধান করতে না পারার কোনো কারণ নেই। পরিণতিতে উপমহাদেশের সব মানুষের কল্যাণে মৈত্রী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাব।

প্রশ্ন: দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের একটা বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমরা দেখছি, একটা দারুণ শূন্যতা, পরম যোগাযোগহীনতা, পরস্পরের সমস্যা সম্পর্কে বোঝাপড়ার চরম অভাব—আমি গণপর্যায়ের কথা বলছি। নতুন পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পরকে বোঝার গতিকে ত্বরান্বিত করতে দুই দেশের সাংবাদিক, সংবাদপত্র, জননেতা বিনিময়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখতে কি আপনি আদৌ প্রস্তুত আছেন?
উত্তর: জরুরি কথাটা আগে সেরে ফেলা যাক। পাকিস্তানের সমস্যা উপলব্ধিতে কোনো ঘাটতি বাংলাদেশের নেই। তবে আমরা দেখছি, দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানে একটি প্রভাবশালী মহলে এখনো আমাদের উপলব্ধি করার ব্যাপারে ঘাটতি রয়ে গেছে, যেমনটা গত ২৫ বছর ধরেই ছিল। আসলে কথা হচ্ছে, উপলব্ধি করার কোনো ইচ্ছা তাদের আছে কি না। অতীতে এ ধরনের অনেক বিনিময়ই হয়েছে কিন্তু তাতে কি গত বছরের বিপর্যয় ঠেকানো গেছে? বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও নৃশংসতা, লাখ লাখ বেসামরিক মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা, লাখ লাখ নারীর ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং দেশজুড়ে গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচার ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিবাদ কি পাকিস্তানে আপনাদের বুদ্ধিজীবী, তথাকথিত প্রগতিশীল মহল ও জননেতারা করেছেন? আসলে যা দরকার, তা হচ্ছে মানসিকতার পরিবর্তন। মূল এই সমস্যার সমাধান একবার হয়ে গেলে আপনারা যে বিনিময়ের কথা বলছেন না, আপনা থেকেই তা শুরু হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: প্রায়ই এ কথা বলা হয়ে থাকে যে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি এবং বাংলাদেশের আইনি স্বীকৃতির আলোচনা—এ দুটোকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের যে অবস্থান, জেনেভা কনভেনশনের পটভূমিকায় আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে তা খারাপ আর নৈতিক দিক অসমর্থনীয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এই সমস্যা দুটোকে বিযুক্ত করা কি আপনার পক্ষে সম্ভব?
উত্তর: এ কথা বলার সময় মনে হয় হয়েছে যে নৈতিকভাবে কোনটা সমর্থনযোগ্য আর কোনটা নয়, এই কথা অন্তত আমাদের যেন বলতে আসা না হয়, আর সব মানুষের মধ্যে আমরা, যারা একটা বর্বরোচিত গণহত্যার শিকার। আপনারা মনে হয় বুঝতেই পারছেন না যে বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। আপনারা কি মনে করেন কেবল দায়িত্ব এড়ানোর জন্য আমরা জেনেভা কনভেনশনের সঙ্গ নিয়েছি? আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো সংশয় আপনাদের থাকা উচিত নয়। জেনেভা কনভেনশন বাস্তবায়ন নিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা-ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে অনুসন্ধান চলছে, তার সার্বিক পটভূমির বিপরীতেই এই সমস্যাকে দেখতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনই আমাদের নীতি।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিলম্বিত করে পাকিস্তান এসব সমস্যা সমাধানে অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তা ছাড়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ইচ্ছা করে পাকিস্তান অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে জাতিসংঘে এসব দ্বিপক্ষীয় সমস্যা তুলে ধরেছে।

বাঙালিদের প্রতি অমানবিক আচরণ এবং তাদের স্বদেশে ফিরতে জোরপূর্বক বাধা সৃষ্টি করে পাকিস্তান পরিবেশ নষ্ট করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে লক্ষ্যবস্তু করে পরিচালিত অপপ্রচারণাও পরিবেশ খারাপ করছে।

দেশের প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞের বিবেচনায় আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যে কত দ্রুত হয়েছে, সেটা হয়তো আমরা উপলব্ধিই করতে পারি না। অচিরেই দেশের একটি সংবিধান হবে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের জনসাধারণের কল্যাণে কাজ করার পাশাপাশি একই ধরনের গঠনমূলক পন্থা আমরা উপমহাদেশের সমস্যাবলি সমাধানেও প্রয়োগ করছি। এসব অগ্রগতির কথা পাকিস্তানের জনসাধারণকে জানাতে হবে, তাদের কেউ কেউ যাতে বোকার স্বর্গে বাস করা বন্ধ করে। এই উপমহাদেশের জনসাধারণের মঙ্গলের দিকে তাকিয়ে পাকিস্তানের উচিত অমীমাংসিত সমস্যাদি সমাধানের এই ঐতিহাসিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।