এমন বন্যা আরও আসতে পারে, প্রস্তুতি নিতে হবে

অধ্যাপক ড. মাসফিকুস সালেহীন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করছেন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য, সরকারের বদ্বীপ পরিকল্পনায় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের নদী ও হাওরের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২৭ বছর ধরে গবেষণা করছেন তিনি। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী, আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে তঁার শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সিলেট বিভাগের বর্তমান ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাসফিকুস সালেহীন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হাওরে হঠাৎ করে বন্যা এল, এত বড় বন্যা হবে, আগে থেকে বোঝা যায়নি কেন?

মাসফিকুস সালেহীন: সিলেট অঞ্চলের বন্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে। বেশির ভাগ মানুষ ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, বোরো ধান কাটার আগে যদি হাওরে ঢলের পানি আসে, তাহলে সেটি বন্যা। আর বাকি সময়ে ঢল এলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে হাওরে ধান কাটার পরে বা বর্ষার সময়েও যদি ঢল আসে, তাতেও সেখানকার অধিবাসীদের অনেক ক্ষতি হয়। গত মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাওরে এক দফা বন্যা হয়ে গেছে। তখনো কিন্তু সেখানকার মানুষের বাড়িঘর, গাছপালা ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এখন যে বন্যাটি শুরু হয়েছে, তা ওই ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেবে। আর এটা মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের যে বিপদগুলো হচ্ছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত হচ্ছে হাওরে অসময়ে ও হঠাৎ করে আসা তীব্র বন্যা, যা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হাওরের বন্যার সঙ্গে দেশের অন্য এলাকাগুলোর বন্যার ধরনে কোনো পার্থক্য দেখেন?

মাসফিকুস সালেহীন: মূলত আসাম থেকে আসা বরাক নদ দিয়ে আসা পানি সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রবেশ করে। আর হিমালয় থেকে সৃষ্টি হওয়া ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রাম দিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করে। ওই দুই অববাহিকার বন্যার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। বরাকের পানি মূলত আসামের উঁচু পাহাড় থেকে ঢল আকারে বরাক হয়ে সিলেটের নদ-নদীগুলোতে আসে। যে কারণে ওই পানির স্রোত অনেক তীব্র হয়। তবে ওই পানি দ্রুত নদী হয়ে হাওর দিয়ে মেঘনায় চলে যায়। সিলেট এলাকা দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে উঁচু হওয়ায় পানি সেখানে বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আর মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকায় যে বৃষ্টি হয়, তা সাধারণত দুই-তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। এবার টানা এক সপ্তাহ ধরে অতিভারী বৃষ্টি হচ্ছে, যে কারণে বন্যার তীব্রতা বেশি দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে দু–এক দিন বিরতি থাকতে বন্যার ভয়াবহতা এত বেশি হতো না। পানি নেমে যেত। এবার তা হয়নি, টানা বৃষ্টি হয়েছে, যা অস্বাভাবিক।

আর ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অপেক্ষাকৃত সমতল হওয়ায় সেখানকার পানি ধীরে ধীরে কুড়িগ্রাম দিয়ে গাইবান্ধা, বগুড়া হয়ে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত চলে আসে। তারপর তা যমুনা ও পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। ফলে এখানকার বন্যা সিলেটের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়। এবার পুরো বরাক উপত্যকা, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রজুড়ে একযোগে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সবখানে একসঙ্গে বন্যা শুরু হয়েছে।

সারা বছরই হাওরে বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিলেটের বন্যার ধরনে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কি না।

মাসফিকুস সালেহীন: এত দিন ধরে এপ্রিল–মে মাসে ঢল বা হঠাৎ বন্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। এখন দেখতে পাচ্ছি জুন থেকে আগস্ট–সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যার ঝুঁকি থাকছে। সারা বছরই হাওরে বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। এমনকি বর্ষার শেষ সময়েও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের উজানে ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টি বেশি হলে বন্যা ও এর ফলে ক্ষতি বেশি হয়। তাই শুধু বোরো মৌসুমে ঢল নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে হবে না। হাওরে এ ধরনের বন্যা ধান কাটার পরও বেশি বেশি করে আসতে পারে। তাতে এখন যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যথাযথ প্রস্তুতি না রাখলে তা সামনের দিনে আরও বাড়বে। এতে মানুষের জীবন, সম্পদ, সড়ক, গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদের অনেক ক্ষতি হবে। হাওরের অবকাঠামো নির্মাণ এমনভাবে করতে হবে, এখানকার জীবনযাত্রা এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে এ ধরনের বন্যা মোকাবিলা করা যায়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কিন্তু হাওরের প্রতিবেশব্যবস্থাকে মাথায় না রেখে ও বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি না রেখে অবকাঠামো নির্মাণের অভিযোগ আছে।

মাসফিকুস সালেহীন: হ্যঁা, এটা ঠিক। দেশের অন্যান্য এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো যেভাবে নির্মাণ করা হয়, হাওরে তা করা যাবে না। এখানকার প্রতিবেশব্যবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকা থেকে পুরোপুরি আলাদা। এখানে বছরে একটি ফসল হয়, বাকি সময় গ্রাম ও বসতিগুলো ছাড়া বাকি এলাকা পানির নিচে থাকে। মৎস্যসম্পদ তখন মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস হয়। ফলে সেখানে এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না, যাতে পানির চলাচলের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, সিলেট এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচুতে, ফলে সেখানে পানি আটকে থাকলে তা দেশের ভাটি এলাকায় হঠাৎ করে পানি নেমে একই ধরনের ক্ষতি করতে পারে। যে কারণে সড়ক, সেতু ও বড় অবকাঠামোগুলোতে পানিনিষ্কাশনের যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হাওরের জন্য যে বন্যা পূর্বাভাসের ব্যবস্থা আছে, তা ঠিক সঠিক বলে মনে করেন?

মাসফিকুস সালেহীন: না, এটা ঠিক নেই। কারণ, হাওরে বন্যার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে দেশের অন্য এলাকাগুলোর মডেল অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ পানি কতটুকু বিপৎসীমা অতিক্রম করল, তার নিরিখে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। আর ওই বিপৎসীমার বিষয়টি ঠিক করা হয় বোরো ধানের জমিতে পানি প্রবেশ করছে কি না, আর নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহের ভিত্তিতে। কিন্তু এখন তো হাওরে ধান নেই, নদ-নদীর পানি খুব বেশি না বাড়লেও অনেক এলাকা দিয়ে উজান থেকে আসা ঢলের পানি প্রবেশ করছে। ফলে সারা বছরের পানিপ্রবাহ ও সম্পদ রক্ষার ভিত্তিতে হাওরের বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মিঠামইন হাওরে ৮০০ কোটি টাকার ওপরে খরচ করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে হাওরের পানি আটকে থাকছে। ভৈরবে মেঘনা সেতুর কারণেও পলি আটকে থাকছে, হাওরের পানি নামতে পারছে না। এমন অভিযোগ অনেকে তুলছেন।

মাসফিকুস সালেহীন: সড়ক বা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের আগে অবশ্যই আমাদের বিশেষজ্ঞ মতামত ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে। সেটা না করে করলে কোনো অবকাঠামো টেকসই হবে না, একই সঙ্গে তা হাওরের প্রতিবেশব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে। ওই সড়ক নির্মাণের ন্যূনতম শর্ত হিসেবে বিভিন্ন পয়েন্টে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাওরে বেশ কিছু জলকপাট তৈরি করা হয়েছে। পলি জমে সেগুলো কার্যকর থাকছে না। ফলে অবকাঠামো নির্মাণের সময় এ বিষয়গুলো খেয়াল করে নির্মাণ করলে আজকে যে সমস্যাগুলো নিয়ে কথা উঠছে, তা উঠত না।

তবে হাওরের ডুবো বাঁধগুলো সেখানকার পানিপ্রবাহ ও প্রতিবেশব্যবস্থার জন্য তেমন ক্ষতিকারক নয়। এসব বাঁধ যাতে আরও শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করা যায়, তা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সামগ্রিকভাবে হাওরের সব অবকাঠামোকে সারা বছরের বন্যা ও দুর্যোগ মাথায় রেখে ঢেলে সাজাতে হবে। নয়তো এ ধরনের দুর্যোগে আমাদের নিয়মিত ক্ষতি হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হাওরে বন্যা তো হবেই। তাহলে এর ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত?

মাসফিকুস সালেহীন: আমরা সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হয়ে সারি গোয়াইন নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছি। তাতে আমরা বলেছি সিলেট ও হাওর এলাকার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা ঠিক হবে না। করতে হবে বন্যা ব্যবস্থাপনা। সেটার জন্য ওই এলাকা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সেখানকার প্রতিবেশ ও পানি ব্যবস্থাপনা বুঝে তারপর পরিকল্পনা নিতে হবে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় আমাদের এখানে বড় সমস্যা হচ্ছে কোনো একটি অবকাঠামো নির্মাণের পর তা মেরামত ও তদারকির কাজগুলো খুব দুর্বলভাবে হয়। হাওরেও আমরা একই বিষয় দেখেছি। ফলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে সিলেটে যে বন্যা ও দুর্যোগ চলছে, তা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। ফলে এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাসফিকুস সালেহীন: আপনাকেও ধন্যবাদ।