করোনাকালে বাক্‌স্বাধীনতা আরও খর্ব হয়েছে

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বার অ্যাট ল। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ঢাকা লিগ্যাল প্র্যাকটিসের সঙ্গে যুক্ত। মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নাগরিকের আইনি প্রতিকার নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলো সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ব্লাস্টের (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট)এক নারী কর্মীর বিরুদ্ধে বিজিবি ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছে। আইনজীবী হিসেবে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানে মানহানির মামলা করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানি সংঘটন করেন, তাহলে মানহানির মামলা হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের কথা নেই। অতীতে এ রকম মামলার নজির নেই।

প্রশ্ন :

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন। জেল থেকে ছাড়া পাবেন কি?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা। একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন, সেটি করেছেন মাগুরার সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর। এরপর যুবলীগ নেত্রী দুটি মামলা করেছেন। ৯ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয়। ১০ মার্চ থেকে তিনি নিখোঁজ। পরে বেনাপোল থেকে উদ্ধার করা হয়। যে মামলায় তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সে মামলায় জামিন পেলেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। আমরা যুক্তি দেখিয়েছি তাঁকে গ্রেপ্তারের পুরো প্রক্রিয়াই অবৈধ।

প্রশ্ন :

তদন্তের ক্ষেত্রে আইনে কী বলা আছে?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলছে, ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৫ দিন বাড়াতে পারেন। সেটি সম্ভব না হলে আদালতের কাছে সময় চাইতে হবে। তিনটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একজনই। মার্চের ১১-১২ তারিখ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হলেও মে মাসে ৭৫ দিন শেষ হয়ে গেছে। আদালতের কাছে অনুমতি চাননি বলে তিনি এই মামলায় তদন্ত করতে পারেন না। পুলিশের এখতিয়ার নেই সময় বাড়ানোর। আদালত আইওকে উপস্থিত হতে বলেছিলেন মামলার তথ্য–প্রমাণাদিসহ। যে আইনে মামলার প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়, সেটি ব্রিটিশ আমলের। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের যে নিয়ম, তা এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ডিজিটাল ফরম্যাটে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেন, যা আপনার জন্য মানহানিকর, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি এমন কিছু করে থাকেন যা অন্তর্জালে সারা বিশ্ব দেখেছে। তাঁর ল্যাপটপ থেকে তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রমাণ নেওয়ার প্রয়োজনও হয়, তাহলে এর একটি কপি তাঁকে দিতে হবে। আরেকটি তারা নিয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

আপনি তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিই বাতিল চাইছেন। তাহলে ব্যক্তির জন্য মানহানিকর কিছু ঘটলে কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কতগুলো স্ট্রাকচার তৈরি করা আছে অপ্রয়োজনীয়। ব্যক্তির মানহানির প্রতিকারে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনই যথেষ্ট। সাংবাদিকেরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়ে বেশি প্রতিবাদ করছেন। বিশেষ করে যাঁরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের জন্য এটি প্রধান অন্তরায়। কোনো অফিসে উৎকোচ দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা ঘটলে সাংবাদিক আগে থেকে তথ্য পাওয়ার আবেদন করতে পারেন না। ৩২ ধারা দিয়ে গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। কেবল সাংবাদিক নন, গবেষকেরাও সমস্যায় পড়বেন। জ্ঞানচর্চার পথই রুদ্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে ৩২ ধারার বাইরে অন্য ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশি মামলা হয়েছে। এই কোভিডের সময় অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার মামলা করেছেন ত্রাণসামগ্রী চুরি-আত্মসাতের রিপোর্ট হওয়ায়। তাঁদের দাবি অনুযায়ী মানহানি হলে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মামলা করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার উৎসাহের কারণ হলো অনির্দিষ্টকাল আটক রাখা যায়। এই মামলায় শাস্তি হচ্ছে ৩ শতাংশের কম। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে মামলা, তার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর। ১০ মার্চ থেকে তিনি গুম হলেন, এরপর কারাগারে। এই মামলায় যদি প্রমাণ হয় তিনি নির্দোষ, তাহলে ক্ষতিপূরণ কে দেবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিম্ন আদালত জামিন দেন না। শফিকুল অসুস্থ, এরপরও জামিন দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন :

তাহলে রাষ্ট্র অন্যায় করলে সাধারণ নাগরিকের প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: এ ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভূমিকা নিতে পারত। ভারতসহ অনেক দেশে রাখছেও। কিন্তু আমাদের এখানে এই প্রতিষ্ঠান আছে নামকাওয়াস্তে। যেখানে সোচ্চার হওয়ার কথা, তারা নিশ্চুপ। ব্রিটিশ শাসনের উদ্দেশ্যই ছিল নাগরিকের অধিকার খর্ব করা। তারা যেখানে গেছে, নিপীড়নমূলক আইনি কাঠামো তৈরি করেছে। পাকিস্তান আমলেও কিছু আইন হয়েছে। ১৯৭২ সালে আমরা নতুন সংবিধান করলাম, তার ১৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হলো এযাবৎকালে যত আইন বলবৎ ছিল, সবই থাকবে। এর অর্থ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আইনের দ্বারাই আমরা শাসিত হচ্ছি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন :

গত দুই মাসে দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়নি। কেউ মারা যায়নি। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটাকে কি ইতিবাচক বলে মনে করেন না?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: সিনহা হত্যার পর থেকে বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। একটা চাপ তো আছে। পুলিশের গুলিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তার নিহত হওয়ার পর তারা সতর্ক হয়েই আইনের প্রয়োগ করছে। তারপরও বলব, দুই মাস ধরে বন্দুকযুদ্ধ না হওয়া ইতিবাচক। আবার অন্য কোনো অজুহাতে শুরু না হয়ে যায়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে বাড়তে দিলে আপনার ঘাড়ে এসে পড়তে পারে।

প্রশ্ন :

কিন্তু বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক দুর্ধর্ষ অপরাধীও ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আমরা যদি ধরেও নিই যে বর্তমান আইন কার্যকর হচ্ছে না, সেখানে উন্নত আইন ও উন্নত বিচারপ্রক্রিয়াই সমাধান হতে পারে। বিচারবহির্ভূত হত্যা নয়।

প্রশ্ন :

দ্রুত বিচার আইনকে কীভাবে দেখছেন?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: এটি সিলেকটিভ বিচার। আমি কখনো এর পক্ষে নই। কোনো মামলা দ্রুত বিচারে যাবে, কোনো মামলা যাবে না, এর মাধ্যমে বৈষম্য করা হলো। সব মামলায়ই বিচারপ্রার্থীর বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।

প্রশ্ন :

মোবাইল কোর্টের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাক্‌স্বাধীনতার বিষয়টিও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: প্রথমত ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা আইন মোবাইল কোর্টে ঢোকানো সঠিক হয়নি। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে এটি টিকবে না। যথাযথ নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। তবে এই যুক্তিটা বড় করে দেখার বিপদ হলো এতে মোবাইল কোর্ট বৈধতা পেয়ে যায়। আমি মোবাইল কোর্ট পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। এই আইন মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হলো। আবার কিছু লোকের হাতে বিচার করার ক্ষমতাও রেখে দিলেন। ২০০৬ সালের পর জুডিশিয়াল সিস্টেমটাই কিন্তু বদলে গেল। মোবাইল কোর্টের নামে যাঁদের এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিচার করার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন আছে।

প্রশ্ন :

করোনাকালে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা আছে?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: কথা বলতে পারার স্বাধীনতা বেশি দরকার ছিল এ সময়ে। কেননা তথ্য আদান-প্রদান সহজ হলে মানুষ তার সুবিধা পেত। কিন্তু এ সময়েই তথ্যের ওপর বিধিনিষেধ বাড়ল। অনেকে নির্যাতনের শিকার হলেন। আমাদের বন্ধুদের একটি গ্রুপ ত্রাণ নিয়ে মনিটরিং করেছিল। সেখানে ২০১৬ সালের খানা জরিপ নিয়ে তুলনা করেছিলাম। কোথায় অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ত্রাণ পরিস্থিতি কেমন। কুড়িগ্রামে গরিব মানুষ বেশি, ত্রাণ বিতরণ হলো কম। আবার খুলনায় দরিদ্রের সংখ্যা কম, ত্রাণের পরিমাণ বেশি। আমরা আনুপাতিক ত্রাণ দেওয়ার কথা বলেছিলাম। দুটি রিপোর্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার কারণে আমাদের এক বন্ধু জেল খেটেছেন দীর্ঘদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। বাক্‌স্বাধীনতা সংকুচিত হতে হতে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন :

উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে মামলা কি কমে গেছে?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: কোভিডের কারণে মামলা কমে গেছে। এ ছাড়া ভয়ের পরিবেশ তো আছে। যোগাযোগের অসুবিধার কারণে অনেক সময় মামলা করাও যাচ্ছে না।

প্রশ্ন :

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হলো। অথচ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও নেই। এতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আদায়ের পথ রুদ্ধ হলো কি না?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: এখানে সমস্যা হলো কোনো আইন বাতিল হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্ববর্তী আইন পুনঃস্থাপিত হয় না। গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বহাল করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করে ষোড়শ সংশোধনী হয়েছিল। আদালত সেটি বাতিল করে দেন। সরকারের পক্ষ থেকে আরেকটি নোটিফিকেশন না দেওয়া পর্যন্ত একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ ফাইল করেছে। এত দিনেও সিদ্ধান্ত হলো না। ফলে একধরনের জবাবদিহিহীনতা থেকেই যাচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।