কৃষকের স্বার্থের কথা কেউ ভাবে না

ড. এম আসাদুজ্জামান
ড. এম আসাদুজ্জামান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া দেশের খাদ্য, কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নীতি ও গবেষণায় যুক্ত আছেন। দেশের বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি, বাজারদর, কৃষির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে এবং কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কয়েক বছর ধরে চালের দাম বেশি ওঠানামা করছে, এর কারণ কী?

এম আসাদুজ্জামান: চালের দাম মূলত সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে। চাল সরবরাহের প্রধান উৎস অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। সেখানে ঘাটতি হলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ে, ফলে বাড়তি চালের দরকার হয়। কিন্তু ধান উৎপাদন সব সময় চাহিদা অনুপাতে না–ও বাড়তে পারে। এ ছাড়া বাজারে নানা নানা পক্ষের তৎপরতা থাকে। ফলে সরবরাহ কমে যায়, তখন দাম বাড়ে।

প্রশ্ন :

চালের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এর জন্য কতটা দায়ী?

এম আসাদুজ্জামান: বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আমরা দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) তৈরির সময় এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু এত বছরেও এর কোনো উন্নতি হয়নি। সরকারের এখানে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। মূলত চালকলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে দাম বাড়লে বুঝতে হবে তাঁদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা আছে। কিন্তু কারা কীভাবে দাম বাড়াচ্ছেন, তা সরকার যদি না জানে, দাম নিয়ন্ত্রণের মতো ব্যবস্থাপনা যদি সরকারের না থাকে, তাহলে দাম নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকে না।

প্রশ্ন :

কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সম্প্রতি এক গবেষণা করে বলেছে, দেশের চাল, আলু ও পেঁয়াজের বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করে।

এম আসাদুজ্জামান: চালের বাজারে সিন্ডিকেটের কথা তো অনেক আগে থেকে চলে আসছে। কিন্তু তাঁদের যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাঁরা কি তা করছেন? তাঁরা কি নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা রাখেন না? এসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। সরকারি সংস্থার গবেষণায় যদি সিন্ডিকেটের তৎপরতার কথা আসে, তাহলে সরকারি সংস্থাগুলো কী করছে, সেই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।

প্রশ্ন :

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে কৃষককে কীভাবে লাভবান করা যায়?

এম আসাদুজ্জামান: চালের মতো ধানের দামও চালকলের মালিকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা যে দামে ধান কেনেন, সেটাই কৃষকেরা পান। সরকার ধানের যে সংগ্রহ মূল্য ঠিক করে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষক পান না। বিশ্বের প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ড বা ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ালে-কমালেও তাদের নিজের দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখে। এর একটি পদ্ধতি আছে। যেমন ধান কাটার পরপর কৃষক তা দ্রুত বিক্রি করে দিতে চান। কারণ, উৎপাদন করতে তাঁর যে খরচ হয়েছে, তা তাঁকে দ্রুত পরিশোধ করতে হয়। কৃষি উপকরণের বড় অংশ তিনি বাকিতে কেনেন। কৃষিমজুরের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হয়। কৃষক একসঙ্গে যখন অনেক ধান বিক্রি করতে বাজারে আসেন, তখন চালকলের মালিকেরা তা কম দামে কিনে নেন। আর বাজারে চালের দাম বাড়লে তাঁরা তা বিক্রি করেন। বাংলাদেশে এ নিয়মই চলছে। কিন্তু থাইল্যান্ড বা ভারতে কৃষক ধান কাটার পর তা কমিউনিটিভিত্তিক গুদামে রাখার সুযোগ পান। স্বল্প সুদে তাঁরা কৃষিঋণও পান। তাঁরা বছর ধরে অল্প অল্প করে ধান বেচেন। ফলে সেখানে চালের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে নিয়ন্ত্রণে থাকে; কৃষকও ভালো দাম পান। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। কৃষিপণ্যের কার্যকর বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

প্রশ্ন :

আমাদের ধান উৎপাদনের ধরনে তো পরিবর্তন এসেছে।

এম আসাদুজ্জামান: আগে ধানের উৎপাদন মূলত আমন মৌসুমের ওপরে নির্ভরশীল ছিল। আশির দশক থেকে বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন দ্রুত বাড়তে থাকে। উচ্চফলনশীল জাতের ধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবমুক্ত সময় শীতকালে হয়। তখন সেচের পানির সরবরাহ ঠিক থাকলে ধানের ফলন নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা থাকে না। শুধু আগাম বন্যা হলে হাওরের বোরো ধানের জন্য বিপদ তৈরি হয়। অন্যদিকে আমনে প্রতিবছরের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ফলন কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে দেশে বোরো ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে।

প্রশ্ন :

তাহলে আমনের ওপর থেকে আমাদের কি নির্ভরশীলতা কমে আসছে?

এম আসাদুজ্জামান: কমে আসছে বলা যাবে না। কারণ, গত দেড় শ বছরে আমাদের এখানে যতবার খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তার প্রধান কারণ ছিল আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফলন কম হলেও দেশে চালের দাম বাড়ে। যদিও ২০১৭ সালে হাওরে বোরো বিপর্যয়ের পর চালের দাম বেড়েছিল। তখন আমদানি করে ওই ঘাটতি পূরণ করা হয়েছিল।

প্রশ্ন :

ধানের উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি আছে?

এম আসাদুজ্জামান: এটা পুরোনো সমস্যা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ফসলের উৎপাদনের একেক রকম তথ্য দেয়। একটার সঙ্গে আরেকটার তথ্যে গরমিলের কারণ হতে পারে তাদের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহকারীরা আসলে মাঠে যান কি না। ফলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে সরকার নীতি–কৌশল নেবে, তা বোঝা মুশকিল। একটি একক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে না পারলে এ সমস্যা থেকেই যাবে।

প্রশ্ন :

চাল ও পেঁয়াজের সংকট এবং আমদানি নিয়েও এবার আমরা জটিলতা দেখলাম। যখন দরকার তখন আমদানি হলো না, যখন আমদানি হলো, তখন চাহিদা থাকল না।

এম আসাদুজ্জামান: এটা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্যা নয়, সেটা বাস্তবায়নের সমস্যা। কখন কীভাবে আমদানি করতে হবে, তা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো মনে হয় বুঝতে পারছে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার দুই মাস পর আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হলো। যাদের আমদানির অনুমতি দেওয়া হলো, তারা আসলে প্রকৃত আমদানিকারক কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। ফলে অনুমতি নিয়ে চাল সঠিক সময়ে আমদানি না করে বাজারে সংকট জিইয়ে রাখা হচ্ছে কি না, তাও দেখতে হবে। আবার যখন কৃষক ধানের একটু ভালো দাম পাওয়া শুরু করেছেন, তখন বাজারে চালের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এসব তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন :

ভারতে তো কৃষকেরা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন। আমাদের কৃষকের অবস্থা কী?

এম আসাদুজ্জামান: ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ভারতের কৃষক আন্দোলনের একটি কারণ। আরও অনেক কারণ আছে। কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বাজারে বড় কোম্পানিগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কৃষকেরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মূলত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের গমচাষিরা এ আন্দোলনের নেতৃত্বে আছেন। ফলে আমাদের কৃষকদের সঙ্গে ভারতের কৃষকদের পরিস্থিতির ভিন্নতা আছে।

প্রশ্ন :

আমাদের এখানে কৃষি ও কৃষকের বড় সমস্যা কী?

এম আসাদুজ্জামান: আমাদের কৃষকদের প্রধান সমস্যা, তাঁদের কথা কেউ ভাবে না। তাঁদের স্বার্থে কথা বলার মতো রাজনৈতিক দল নেই। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ ও পানির সমস্যা সামনের দিনে অনেক বড় আকার ধারণ করবে। এখানে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পানির ব্যবহার হয়। কারণ, এখানকার কৃষকেরা পানিতে ডুবিয়ে ধান চাষ করতে অভ্যস্ত। কম পানিতে চাষের পদ্ধতি বের করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পানি সরবরাহকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। তখন তাঁদের প্রণোদনা দিতে হবে।

প্রশ্ন :

কৃষি উৎপাদন কি আরও বাড়ানো সম্ভব?

এম আসাদুজ্জামান: অবশ্যই সম্ভব। এখনো সব ধরনের ফসলের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ানো যাবে। আমরা আদা, রসুন, পেঁয়াজ, ডাল ও সয়াবিন বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটাচ্ছি। এগুলো দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। আমাদের বিজ্ঞানীদের শুধু চাল ছাড়াও অন্য ফসলগুলোর উন্নত জাত উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এম আসাদুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।