কেন এ উদ্যোগ তা পরিষ্কার নয়

প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগ নিয়ে নানা মহলে রয়েছে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেনের সাক্ষাৎকার।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন

প্রশ্ন :

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

মো. তৌহিদ হোসেন: সরকারের এমন উদ্যোগ নেওয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কেন তা নেওয়া হচ্ছে, তা আমার কাছে খুব পরিষ্কার নয়। বলতে পারেন সরকারের এ উদ্যোগ আমার কাছে দুর্বোধ্য। আমাদের দেশে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে এবং তারা মূলত কক্সবাজার ও টেকনাফের শিবিরগুলোতে রয়েছে। সেখান থেকে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নিলে কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চলের পরিস্থিতির উন্নতির তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। আশ্রয়শিবিরগুলোর কারণে সেখানকার পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের যে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, সেটা টিকিয়ে রাখার জন্য অবশিষ্ট ১০ লাখ রোহিঙ্গা যথেষ্ট। ভাসানচরে প্রচুর অর্থ খরচ করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া সেখানে তাদের পাঠাতে ও রাখতে সরকারের বিপুল অর্থ খরচ হবে। এত কিছুর পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি মানবাধিকার সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেকে এ উদ্যোগের বিরোধিতা করছে। এখানে মনোমালিন্য বাড়িয়েই বা আমাদের কী লাভ হলো? আমি এই উদ্যোগটির কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না।

প্রশ্ন :

সরকার কি মনে করছে রোহিঙ্গাদের আর ফেরানো যাবে না, তাই স্থায়ী কিছু করার ভাবনা থেকেই এ উদ্যোগ নিয়েছে?

মো. তৌহিদ হোসেন: সরকার কী ভাবছে, সেটা বলা কঠিন। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে যদি আরও দুই বছর বা এমনকি ১০ বছরও লাগে, তা–ও বিষয়টিকে স্থায়ী ভাবার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। তারা যত দিন আছে, তত দিন তাদের জন্য খাবার ও আবাসের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আমরা করব কিন্তু তা অস্থায়ী ব্যবস্থা। সরকার রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসনচরে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানকার থাকার ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কক্সবাজারের চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু এটা কোনো অবস্থাতেই স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না।

প্রশ্ন :

আপনি বললেন এবং অবস্থাদৃষ্টে এটা বোঝা যাচ্ছে যে ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা ও আবাসনব্যবস্থা কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরগুলোর চেয়ে ভালো। কিন্তু এরপরও তাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে বিরোধিতা করছে কেন?

মো. তৌহিদ হোসেন: দেখুন, আমি আগেই বলেছি, সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কোন বিবেচনা থেকে নিয়েছে, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া খুবই বিরক্তিকর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যারা মানবাধিকার নিয়ে ভাবছে, তাদের কাছে আসলে কোনটা বড়? রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়ন, নাকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অন্য শিবিরে স্থানান্তর। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলো মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? এমন কিছু তো দৃশ্যমান নয়। মানবাধিকার এখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে না, লঙ্ঘিত হয়েছে মিয়ানমারে। শিবির স্থানান্তর করে বরং রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে অভিযোগ আছে যে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

মো. তৌহিদ হোসেন: এটা আসলে খোঁড়া যুক্তি। বিশ্বের অনেক দেশেই শরণার্থী আছে, শরণার্থীরা যা চায় বা যেভাবে চায়, সেটা কি মেনে চলা সম্ভব? তারা যেখানে থাকতে চাইবে, সেখানেই কি আমাদের থাকতে দিতে হবে। বাংলাদেশ তাদের প্রবেশ করতে না–ও দিতে পারত। কিন্তু আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি, ফলে তাদের আবাসন ও খাবারের দায়িত্ব আমাদের নিতে হচ্ছে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনাগত সুবিধার দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে। কোথায় রাখলে তাদেরকে যথাযথ দেখভাল করা যাবে, সেটা ঠিক করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে।