গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে জোরালো প্রচার দরকার

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেন একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং পাকিস্তানিদের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন :

দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চালায়। বাংলাদেশ প্রতিবছর ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ কী?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমার মনে হয় তিনটি কারণে এখনো আমরা এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে পারিনি। একটি দেশের গণহত্যাকে যে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ঘাটতি আছে। আমাদের এখানে বেশির ভাগ গবেষণা হয়েছে বাংলায়। গণহত্যা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের উদ্যোগেরও ঘাটতি আছে। গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ আছে। তবে তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি। বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রধান শহর যেমন লন্ডন, ওয়াশিংটন, বেইজিং, টোকিও, দিল্লি, মস্কো প্রভৃতি স্থানে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। গণহত্যা নিয়ে প্রচুর বই, প্রদর্শনী, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে হবে। এখন কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। আজ ২৫ মার্চ (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা) যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছে। পাঁচ বছর ধরেই আমরা এ ধরনের সেমিনার করে আসছি। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে পণ্ডিত ও পার্লামেন্ট সদস্যরা যোগ দেবেন। থাকবেন লন্ডনে অবস্থানরত রুয়ান্ডার হাইকমিশনারও। মূল প্রবন্ধ পড়বেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এ প্রচার পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে দিতে হবে। ওয়েবিনারে সেমিনার করলে স্বল্প খরচে সেটি সম্ভব। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সেই সুবিধা দিয়েছে।

প্রশ্ন :

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রভাব কতটা আছে বলে মনে করেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: এখন আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের তেমন প্রভাব নেই। তবে একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের পক্ষে ছিল। ওই সব দেশ ও অঞ্চলে পাকিস্তান তাদের মতো করে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। এর বিপরীতে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তানিরা মৃতের সংখ্যা নিয়ে একটি অহেতুক বিতর্ক তৈরি করছে। একাত্তরে পাকিস্তানিরা আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। দুই লাখের বেশি মা-বোন তাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, গণহত্যা কখনোই মৃতের সংখ্যা দিয়ে নিরূপিত হয় না। গণহত্যা হলো কোনো গোত্র, জাতি কিংবা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত বলপ্রয়োগ। জাতিগত নিধন। যেকোনো বিচারে পাকিস্তানিদের অভিযান ছিল গণহত্যা এবং সেটি তারা যে কেবল ২৫ মার্চই করেছে, তা নয়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ গণহত্যা চালিয়েছে। এই যে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, সে তো এমনি এমনি নয়। সবকিছু হারিয়ে তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। তাই পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে আমাদের লাগাতার প্রচার চালাতে হবে। আমি হতাশ নই। আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে ১০০ বছর লেগেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আসবে একদিন।

তিনটি কারণে এখনো আমরা এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে পারিনি। একটি দেশের গণহত্যাকে যে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ঘাটতি আছে। আমাদের এখানে বেশির ভাগ গবেষণা হয়েছে বাংলায়। গণহত্যা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম

প্রশ্ন :

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে ভূরাজনীতি কতটা কাজ করেছে বলে মনে করেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাদেরও একটা দায় আছে। কেননা, পাকিস্তানি সেনারা যে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, সেটি তো তাদের নিজস্ব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের। পাকিস্তানি প্রচার যত জোরদারই হোক না কেন, এর বিরুদ্ধে আমাদের তথ্যপ্রমাণ দলিলপত্র হাজির করতে হবে। গণহত্যার নিদর্শনগুলো সামনে আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি ওয়াকিং মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছি; যেখানে পথচারীরা কিছুক্ষণ এগোলেই গণহত্যা নিদর্শনগুলো দেখতে পাবেন।

প্রশ্ন :

গণহত্যার নিদর্শন সংরক্ষণে আমরা কতটা আন্তরিক? অনেক নিদর্শন হারিয়ে গেছে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: অনেক বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গণহত্যার অনেক স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে। খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদদের স্মরণে অনেক স্মৃতিসৌধ হয়েছে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে বলে মনে করি। একাত্তরে যে এক কোটি মানুষ শরণার্থী হলেন, তাঁদের কতজনের কাহিনি আমরা জানি? এক কোটি না হোক, আমরা অন্তত ১০ লাখ লোকের দেশান্তরের কাহিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারতাম। দেশের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও প্রত্যেকের কাহিনি আছে।

প্রশ্ন :

আমরা একাত্তরের গণহত্যার দায়ে এ-দেশীয় অপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি, যারা পাকিস্তানিদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু যাদের নির্দেশে ও পরিচালনায় ৯ মাস ধরে গণহত্যা চলেছে, সেই পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের বিচার করতে পারিনি। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়, সেখানে পাকিস্তান একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। ক্ষমা চায়নি। দুঃখ প্রকাশ করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য। বাংলাদেশও জাতিসংঘের সদস্য। একটি সদস্যদেশের মানুষের ওপর আরেকটি দেশের সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযান কখনো বৈধতা পেতে পারে না। পাকিস্তানি অনেক সেনা কর্মকর্তার ডায়েরিতেই গণহত্যার তথ্য-প্রমাণ ছিল। হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনেও গণহত্যার বিষয়টি এসেছে। এত কিছুর পর পাকিস্তানিরা অস্বীকার করবে কীভাবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (বাংলাদেশ) দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ায় একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে আসে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দাবি আরও সুদৃঢ় হয়েছে।

প্রশ্ন :

আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি করছি। কিন্তু দেশের মানুষ এ গণহত্যা সম্পর্কে কতটা জানেন বা জানানোর চেষ্টা আছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, যুদ্ধাপরাধ সত্যতা কমিটি দীর্ঘদিন ধরেই এর পক্ষে কাজ করছে। সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ-ছয় বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু ১৯৭২-৭৩ সালে এ ধরনের সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম আরও বাড়ত। এ সেন্টারে আমরা গণহত্যা নিয়ে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছি। ফেলোশিপ চালু করেছি। আরও অনেক সংগঠন জনমত তৈরিতে কাজ করছে। প্রতিবছর ডিসেম্বরে আমরা গণহত্যা নিয়ে সেমিনার করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফা গণহত্যা হয়েছে। প্রথম দফা মার্চে, দ্বিতীয় দফা ডিসেম্বরে।

প্রশ্ন :

আপনি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কথা বলছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কতটা উদ্যোগ আছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি এখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অনেক বেশি জরুরি। রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরা সম্ভব, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা নয়। একাত্তরে যেসব দেশ আমাদের সহায়তা করেছিল, যেমন ভারত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তাদের মহাফেজখানায় যেসব তথ্য-প্রমাণ আছে, সেগুলোও সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

পাকিস্তানে সংখ্যায় কম হলেও কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমাদের কি উচিত নয় তাদের সহায়তা করা?

ইমতিয়াজ আহমেদ: অবশ্যই তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। একটা বড় সমস্যা হলো পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম একাত্তরে কী ঘটেছে, তা জানে না। তাদের জানতে দেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক কালে কিছু কিছু লেখক-বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এসেছেন। আমাদের উচিত হবে সেখানে জনমত গঠন করা। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে কী ঘটেছে, তা জানাতে হবে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভেতর থেকেই প্রতিবাদ আসবে।

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক মহলে গণহত্যার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কথা বলছেন। কিন্তু এ বিষয়ে দেশে কি রাজনৈতিক ঐক্য আছে বলে মনে করেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমাদের এখানে রাজনৈতিক বিভাজন আছে, এ কথা ঠিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা ক্ষমতায়। অন্যদিকে যত রাজনৈতিক বিভাজনই থাকুক না কেন ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণহত্যার প্রশ্নে দ্বিমত করবেন বলে মনে হয় না। অন্তত পাকিস্তানিদের ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে আমরা রাজনৈতিক ঐকমত্য দাবি করতে পারি।

প্রশ্ন :

লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স (ল্যামস) সম্প্রতি ১৯৭১ নিয়ে ওয়েবিনারে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্যোগ নিয়েও পরে বাতিল করে দিয়েছে। কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি এ ঘটনায় মোটেই বিস্মিত হইনি। ২০১৪ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেই সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু খবরটি জানাজানির পর সেখানকার জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন প্রতিবাদ করল। মিছিল বের করল। উপাচার্যের কাছে ধরনা দিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়। এর কারণ একাত্তরের গণহত্যার ওপর আমার বই হিস্ট্রসিজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভারসাস পারসন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানিরা তাদের অসহিষ্ণুতার প্রমাণ আরেকবার দিল। যে জনগোষ্ঠী একটি বই সহ্য করে না, সেই জনগোষ্ঠী একাত্তরের ওপর আন্তর্জাতিক সেমিনার কীভাবে সহ্য করবে?

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ

ইমতিয়াজ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।