ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই অপপ্রয়োগ

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বার অ্যাট ল। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ঢাকা লিগ্যাল প্র্যাকটিসের সঙ্গে যুক্ত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ সম্প্রতি কারাগারে মারা যান। একই মামলায় আটক আছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন নাগরিকের আইনি সুরক্ষা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ সম্প্রতি কারাগারে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। এই মামলার একজন আইনজীবী হিসেবে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তিনি ১০ মাস ধরে কারাগারে আটক ছিলেন। আমাদের এখানে সেনটেন্সিং পলিসি বা দণ্ড প্রদানের নীতি নেই। বিচারের আগে একজন আসামিকে কত দিন আটক রাখা যাবে, তার সুনির্দিষ্ট আইন নেই। অথচ আমরা ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে যে দেশের আইন অনুসরণ করি, সেই যুক্তরাজ্যে কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইন আছে। এ কারণে বিচারের আগেই অনেকে বছরের পর বছর কারাগারে আটক থাকছেন। এটি আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে আছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকোনো স্থানে বসবাসের...অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

প্রশ্ন :

মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করা হয়েছিল। এ আইনে তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। তা পাওয়া গেছে কি?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আইনে বলা আছে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে নিতে পারেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ৭৫ দিন পার হওয়ার পর তাঁদের কিছু করার থাকবে না। এরপর ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। প্রাক্‌–বিচার শাস্তি তো অনন্তকাল চলতে পারে না। ধরুন, বিচারে কোনো আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলো না, বিচারকের রায়ে তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন। তাহলে এই যে একজন আসামি ১০ মাস বা আরও বেশি জেল খাটলেন, তার প্রতিকার কী।

প্রশ্ন :

সে ক্ষেত্রে কি তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আমি মনে করি, মুশতাক আহমেদের মামলা যিনি তদন্ত করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। নেওয়া উচিত। মুশতাক আহমেদ আগে জামিনে বেরিয়ে এলে এভাবে তাঁর মৃত্যু না-ও হতে পারত। একজন মুক্ত মানুষের সঙ্গে একজন বন্দী মানুষের বিরাট পার্থক্য। মুশতাক আহমেদকে ১০ মাস কারাগারে আটক রাখা হলো। জেল কোড অনুযায়ী ১০ মাসেই এক বছর। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিলেন গত ১১ জানুয়ারি, দেওয়ার কথা ছিল গত বছর ২০ জুলাইয়ের মধ্যে। যে ছয়জন ব্যক্তির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনেই দেখলাম, তাঁদের পাঁচজনই বলেছেন তাঁরা কিছু জানেন না। পুলিশের কাছে কোনো সাক্ষ্য দেননি। লেখালেখির কারণে একজন লেখকের এত দিন আটক থাকা এবং সুস্থ-সবল একজন মানুষ, তাঁর তো এভাবে মারা যাওয়ার কথা ছিল না। এটিকে আমরা ন্যাচারাল ডেথ বা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নিতে পারছি না। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ছিলেন। একজন লেখক ছিলেন। লেখালেখির কারণে একজন মানুষ এভাবে মারা গেলেন। এটি জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের নিরাপত্তা হরণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন :

তাহলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তার প্রতিকার পাওয়ার উপায় কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো প্রয়োজন নেই। এই আইন কারও নিরাপত্তা দিতে পারেনি। আপনি যে ডিজিটাল নিরাপত্তার কথা বলছেন, ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইন সংস্কার করে তার সুরক্ষা দিতে পারে। অনেক মানবাধিকারকর্মী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিশেষ ধারা বাতিলের দাবি করছেন। আমি মনে করি, পুরো আইনই বাতিল করা উচিত।

প্রশ্ন :

আইনজীবী হিসেবে বলুন, মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার ভিত্তি কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ভেক চার্জ। ভুয়া অভিযোগ। জুজুর ভয় দেখানো। জাতির জনকের বিরুদ্ধে প্রচারণার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কী অপপ্রচার তা বলেনি। এ হলো মুখ বন্ধ করার কৌশল। এ ছাড়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে প্রচারণার কথা বলা হয়েছে, তা–ও গোলমেলে। রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। সরকারের সমালোচনা করলেই তা রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না। এ ব্যাপারে আমাদের আদালতের রায় না থাকলেও ভারতের আদালতের সুস্পষ্ট রায় আছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালে রায় দিয়েছেন, সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধিতা এক নয়। নাগরিকের টাকায় যাঁদের বেতন হয়, নাগরিকেরা যাঁদের নির্বাচিত করেন, তাঁদের সমালোচনা করার অধিকার তাঁদের আছে। কোভিডের পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অনিয়ম নিয়ে কার্টুন আঁকা ও প্রচার করা রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না। এটি নাগরিক অধিকার।

প্রশ্ন :

কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের মামলার শুনানি ছিল রোববার। আপনি তাঁর পক্ষেও আদালতে আইনি লড়াই করছেন। পুলিশ আবারও তাঁর রিমান্ড চেয়েছিল। কারাবন্দী আসামির রিমান্ড চাওয়ার যুক্তি কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: প্রথম অভিযোগপত্র দেওয়ার পর যদি নতুন কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে অধিকতর তদন্তের সুযোগ নেই। সুতরাং তাঁরা রিমান্ড চাইতে পারেন না। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা যদি নতুন কোনো তথ্য পান, তিনি আদালতের কাছে তা যুক্ত করার অনুরোধ জানাবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(৩বি) ধারায় এ বিধান আছে। আক্কাস আলী বনাম রাষ্ট্র, আফিয়া খাতুন বনাম রাষ্ট্র মামলায়ও আদালতের অনুরূপ নির্দেশনা আছে।

প্রশ্ন :

আদালতে শুনানিতে অংশ নিয়ে আপনি পুলিশের রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করেছেন। মাননীয় বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর করেননি। আপনার যুক্তি কী।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: রিমান্ড চাওয়ার কোনো এখতিয়ারই তাঁদের ছিল না। কোনো আসামির রিমান্ড চাইতে হলে তাঁকে আদালতে হাজির করতে হবে। কিন্তু সরকারপক্ষ সেদিন তাঁকে আদালতে হাজির করেনি। সেখানে রিমান্ডের আবেদন শোনার কোনো সুযোগ নেই। কিশোর তো সরকারের হেফাজতে ছিলেন।

প্রশ্ন :

অনেকে বলে থাকেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর অপব্যবহার রোধ হওয়া প্রয়োজন।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: অনেক মানবাধিকারকর্মী এসব কথা বলেন। আমি আপত্তি করি। আমি মনে করি, আইনটির ব্যবহারই অপব্যবহার। আইনটি এমনভাবে তৈরিই করা হয়েছে, এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই আইনে যাঁর বিরুদ্ধে মামলা
হয়, প্রথমেই তাঁকে সামাজিকভাবে হেয় ও অসম্মান করা হয়। আইনটির বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। ফলে আসামি আইনি লড়াইয়ের স্বাভাবিক সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। এই আইনের প্রায় সব ধারাই নিবর্তনমূলক। প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগের বিতর্কে না গিয়ে আমি বলব, আইনটিই খারাপ।

প্রশ্ন :

তাহলে ডিজিটাল অপরাধ রোধের উপায় কী?

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: ২০০৬ সালের আইসিটি আইনটি এখনো বহাল আছে। এর চারটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। আমি মনে করি, সেই ধারাগুলো সংশোধন করে এই অপরাধের বিচার করা সম্ভব। এই যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজে নারী ও শিশুদের নানাভাবে হয়রানি ও
নিগ্রহ করা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিন্তু তার প্রতিকার করতে পারেনি। ডিজিটাল অপরাধ রোধ করতে আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রাখার কোনো যুক্তি নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।