দেশে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজ করছে

প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ২২ আগস্ট দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি সঠিক পথে চলছে? না চললে এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে না। তবে যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা বলছেন যে দেশ সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ যে সঠিক পথে চলছে না, তার জন্য গোটা জাতিই দায়ী। যারা যত বেশি ক্ষমতাবান ও সম্পত্তিশালী, তারা তত বেশি দায়ী। আমাদের ইতিহাসের কেবল গৌরবজনক দিকগুলোই আলোচিত হয়। ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতার দিকগুলোও আলোচিত হলে বোঝা যেত যে কীভাবে কেন রাজনৈতিক দিক দিয়ে আমরা এই দুরবস্থায় পড়লাম। গত শতকের ষাটের দশকে ছয় দফা আন্দোলনকালে রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রকৃত জাতীয় ঐক্য হয়নি। আওয়ামী লীগ চলেছিল ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে। তখন নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে নেতৃত্ব জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এসব সমস্যা অত্যন্ত জটিল রূপ নিয়ে দেখা দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল (১৯৭২-৭৫) থেকেই। তখন বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা গঠনমূলক ছিল না। বুদ্ধিজীবীদের প্রধান অংশের ভূমিকাও ভালো ছিল না। গোটা জাতি নৈতিক দিক দিয়ে পতনশীল অবস্থায় পড়ে যায়। এসবের মধ্য দিয়ে জাতীয় ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর সেই গণতন্ত্রের অবস্থা কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ যেভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে, তাতে গণতন্ত্র এখন আমাদের এক হারানো প্রত্যয়। গণতন্ত্র নিয়ে মামুলি আলোচনার এখন আর কোনো অর্থ হয় না। গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে গভীর আলোচনা দরকার। আলোচনা শুরু করতে হবে অ আ ক খ থেকে। আমাদের রাজনীতিতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে জনজীবনে সম্ভাবনা আছে। জনসাধারণ এখন ঘুমন্ত। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রার শুরুতেই ধাক্কা খেল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দল সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইল। অন্যদিকে বামপন্থীদের একাংশ স্বাধীনতাকেই মানতে চাইল না। সংকটের শুরু কি সেখান থেকেই?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: তাজউদ্দীন সরকার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার জন্য এবং যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে কাজ করার জন্য ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর চারটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল—১. মুসলিম লীগ, ২. নেজামে ইসলাম, ৩. জামায়াতে ইসলামী ও ৪. পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। এই চার দল ছাড়া বাকি সব দলই ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবে কয়েকটি দল আওয়ামী লীগের বিরোধী ছিল। আওয়ামী লীগের বিরোধিতার অর্থ স্বাধীনতার বিরোধিতা নয়। ১৯৭২ সাল থেকে দরকার ছিল স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তিকে রাজনীতিতে সক্রিয় রাখা। পাকিস্তানপন্থী বলে, দেশের শত্রু বলে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা ঠিক হয়নি। যারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার বিরোধী কিংবা আইনের শাসনের বিরোধী, তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। বামপন্থীদের রাজনীতি অবশ্যই ভুল ছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: যেসব দল এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে, তাদের মধ্যে প্রধান দলগুলো অস্বৈরাচারী ছিল না। আন্দোলন ছিল সরকার উৎখাতের ও ক্ষমতা দখলের। গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও প্রস্তুতি দরকার হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের উপায় হলো নির্বাচন। এই নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য কাকে দায়ী করবেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: ১৯৮০-এর দশকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি দল গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে। এতে গণতন্ত্রের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সব কর্মনীতি পরিহার করা হয়। নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রের এই ধারণা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, অন্যরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ আরও কত কিছু করেছে। তারা নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখেনি। তারা নির্বাচন করার জন্য সুষ্ঠু দলীয় কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করার জন্য বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও কাজ করছে। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের জন্য নতুন রাজনীতি দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কর্তৃত্ববাদ ও জঙ্গিবাদ—দুটিই বাংলাদেশের বিপদ। একটি রেখে আরেকটির অবসান কি সম্ভব?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: কর্তৃত্ববাদ ও জঙ্গিবাদ দূর করার জন্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র দরকার। সন্ত্রাস দূর করার জন্য বাংলাদেশে অপারেশন ক্লিনহার্ট, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি চালানো হয়েছে। এভাবে সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এই মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন রাজনীতিতে ধর্মীয় শক্তির পুনরুত্থানে সহায়ক হয়েছে। এখন বুঝেশুনে কাজ করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। সমাধান স্বল্প সময়ে সহজে হবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ বলেন বাঙালি, কেউ বাংলাদেশি। আবার কেউ ইসলামি শাসনের কথাও বলেন। এই বিতর্কের শেষ কোথায়?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাঙালি-বাংলাদেশি বিতর্ক এখন আর নেই। সেটা ছিল জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক বিতর্ক। জাতীয়তাবাদ দরকার হয় রাষ্ট্র গঠনের জন্য, জাতীয় ঐক্য বা ঐকমত্যের জন্য। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কোনোটিই এখন আর রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে আগ্রহী নয়, দুটি দলই চায় কেবল রাজত্ব করতে। ফলে কেউ এখন আর জাতীয়তাবাদী নেই। মুসলিম বাংলা গঠনের চিন্তা করছেন কেউ কেউ। রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একসময় আপনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন বলছেন, বামপন্থা সমাধান নয়। তাহলে কি এত দিন ভুল রাজনীতি করেছেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমাদের দেশে বামপন্থী রাজনীতি ভুলভাবে অনুশীলিত হয়েছে। তবে তখন শুদ্ধতার দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। এখন অবস্থা মৌলিকভাবে বদলে গেছে। বামপন্থী রাজনীতির সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে। ভুল তো হয়ে থাকতেই পারে। এসব কথা এত সংক্ষেপে আলোচনা করা যায় না। আমার কোনো কোনো বইয়ে এসব বিষয়ের আলোচনা আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। সরকারও নড়েচড়ে বসেছে। এর আগেও অনেক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তখন কেন প্রতিবাদ হয়নি?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড বলে সরকার ও অন্য সবাই এ ঘটনায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আসলে সব হত্যাকাণ্ডের পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাওয়া উচিত। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডই অনুমোদনযোগ্য নয়। বাংলাদেশ অভিহিত হচ্ছে বিচারহীনতার দেশ বলে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি আছে। সে কারণেই শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে। গোটা দেশ এই নীতি ও ব্যবস্থা নিয়ে চলছে। অবস্থার উন্নতির জন্য কোনো মহল থেকেই কোনো উদ্যোগ বা আন্দোলন নেই। আসলে এটি জাতীয় ব্যর্থতা। গোটা জাতিই এর জন্য দায়ী। তবে যারা যত ক্ষমতাবান, তারা তত বেশি দায়ী।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি করেছে। আবার ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানও বেড়েছে। এর প্রতিকার কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: এর প্রতিকার বের করতে হবে। জনসাধারণ ও নেতৃত্ব—উভয় দিকেরই নৈতিক উন্নতি দরকার। গোটা পৃথিবীতেই চলছে এটা। এর জন্য জাতিভিত্তিক আলোচনা যেমন দরকার, তেমনি দরকার বৈশ্বিক আলোচনা। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থায় মৌলিক পুনর্গঠন লাগবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনার লেখা ও কথায় রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। কিন্তু উত্তরণের উপায় কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: সংকট নিয়ে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করি এবং সমাধানের উপায়ও নির্দেশ করি। আসলে চিন্তা যেমন দরকার, তেমনি দরকার কাজ। কাজের জন্য দরকার উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ‘আটাশ দফা: আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ নামের একটি বক্তব্য পুস্তিকা আকারে আমি ১৬ বছর ধরে প্রচার করে আসছি। আমার ধারণা, এতে উত্তরণের উপায় নির্দেশিত আছে। এর বাস্তবায়ন দরকার। এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো বক্তব্য এ বিষয়ে আমি খুঁজে পাইনি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে দীপন মারা যাওয়ার পর আপনি খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না।’ কিন্তু অপরাধের বিচার পাওয়া তো মানুষের মৌলিক অধিকার। দীপন হত্যার বিচার এখন কোন পর্যায়ে আছে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আগামী ৩০ অক্টোবর দীপন হত্যার পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। এর মধ্যে শুনানি শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের ঠিক আগে। তিন-চার দিন শুনানি হয়েছিল। এরপর করোনার কারণে আর শুনানি হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: লেখক হিসেবে আপনি কতটা স্বাধীন? যা চিন্তা করেন, বলতে পারেন কি? প্রধান হুমকিটা কোন দিক থেকে আসে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: সরকারি আইনকানুন, আদালতের নির্দেশ ইত্যাদি দ্বারা গত ১০ বছরের মধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দারুণভাবে খর্ব করা হয়েছে। ছাত্র-তরুণেরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকেরা ফেসবুকে নানা কথা প্রচারের জন্য গ্রেপ্তার হচ্ছেন এবং কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এক অস্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে দেশে। সরকারের চেয়ে সরকারি দল সমাজের স্তরে স্তরে এমনভাবে দৌরাত্ম্য করছে যে লোকে অনেক বিষয়ে একান্ত ন্যায়সংগত ও আইনসংগত কথাও বলতে সাহস করে না। রাজনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। বুদ্ধিজীবীরাও সরকারি দলের আবর্তে বন্দী। দেশে চিন্তার চর্চা নেই। চিন্তার চর্চা না থাকাটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের লক্ষণ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।