পরিবেশ শ্বাসরুদ্ধকর, কিন্তু হতাশ হলে চলবে না

ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস এবং আজ ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস। প্রধানত এই দুটি প্রসঙ্গ ঘিরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলছেন সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও লেখক আকবর আলি খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

আকবর আলি খান
ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। আপনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপর দেশ পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন পেশাগত জীবনের পুরোটাই। প্রায় অর্ধশতক পর এই বিজয়ের মাসে আপনার অনুভূতি কী? স্বাধীন হয়ে আমরা কী পেয়েছি?

আকবর আলি খান: এই ৪৯ বছরে বাঙালি জাতির অনেক বড় প্রাপ্তি ঘটেছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আমাদের স্বাধীনতা। আমরা যে আমাদের জীবনে এই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারব, সেটা অনেকেই বিশ্বাস করত না। কিন্তু বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই স্বাধীন হয়েছে। একটা স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় বড় অর্জন হলো দারিদ্র্য হ্রাস। স্বাধীনতার আগে এই দেশে ব্যাপক দারিদ্র্য ছিল। এই ৪৯ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের ক্রমান্বয়ে হ্রাস ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন খেতে পায়, কাপড় পরতে পারে, জুতা পরতে পারে; দারিদ্র্যের অনেক চিহ্ন বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। এই দুটি বড় অর্জনের জন্য আমরা গর্বিত।

প্রশ্ন :

কিন্তু শুধু খেতে-পরতে পাব, এই জন্য কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন ছিল না?

আকবর আলি খান: বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন দেশে বাস করবে, খেয়ে-পরে জীবন যাপন করবে—আমরা শুধু এটাই আশা করিনি। আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জনগণের ইচ্ছা অনুসারে দেশ শাসিত হবে। এই ক্ষেত্রে অনেক ওঠানামা হয়েছে এবং এখনো স্পষ্ট নয় যে আমরা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে কতটুকু এগোতে পেরেছি। এটা একটা বড় ব্যর্থতা। এর সঙ্গে সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা হলো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে সুশাসনের ঘাটতি ঘটেছে। সুশাসনের ঘাটতির ফলে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, মানুষের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। প্রথম দুটি দিকে আমরা অবশ্যই অনেক কিছু অর্জন করেছি, কিন্তু পরের দুটি দিকে আমরা এখনো আশানুরূপ অগ্রগতি ঘটাতে পারিনি।

প্রশ্ন :

সুশাসনের প্রশ্নে পাকিস্তান আমলে এ দেশের মানুষ সরকার বা জনপ্রশাসনের কাছ থেকে যেসব সেবা যেভাবে পেত, আমরা কি এখন তার চেয়ে বেশি পাচ্ছি? নাকি উল্টোটা ঘটেছে? পাবলিক সার্ভিসের মানের কি অবনতি ঘটেনি?

আকবর আলি খান: পাকিস্তান আমলে অর্থের সমস্যা ছিল। সে কারণে সরকারের সেবা অত্যন্ত সীমিত ছিল। আমি এখন পাকিস্তান আমলের সঙ্গে তুলনা করব না; আমরা যদি বাংলাদেশেই ৮০-৯০ দশকের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে আমরা এগোতে পারিনি; আমাদের অনেক এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়।

প্রশ্ন :

আপনি তো দীর্ঘ সময় জনপ্রশাসনে ছিলেন। আপনার কী মনে হয়, আমরা কেন, কী কারণে এই ক্ষেত্রে এগোতে পারলাম না, নাকি আরও পিছিয়ে গেছি? এই পরিস্থিতি কেন হলো?

আকবর আলি খান: যে বড় দুটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে আমাদের দেশ শাসন করে আসছে, তারা ক্ষমতার ব্যাপারে যতটা আগ্রহী, জনপ্রশাসনের সংস্কার সাধন, জনগণের সেবার মান উন্নত করা, সুশাসন বাড়ানো—এই সব ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নয়। সংস্কার করলে কারোর স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে, কারোর লাভ হবে—সুতরাং সংস্কার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের জন্য সুবিধাজনক নয়। সে জন্য রাজনীতিকেরা সব সময় সংস্কার এড়িয়ে যেতে চান। তবে জনপ্রশাসনের সংস্কার না হলেও বর্তমানে কিছু আশার দিক দেখা দিয়েছে। সেটা হলো ডিজিটাল ব্যবস্থার ফলে আমরা আরেকটা সুশাসনের দিকে ধীরে ধীরে হলেও যাচ্ছি। যেমন ধরা যাক, পেনশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে আগে পেনশন ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি ছিল; কর্মকর্তাদের অবসরে যাওয়ার পর পেনশন পাওয়া একটা বিভীষিকা ছিল। এখন এখানে কম্পিউটার পদ্ধতি চালু করার ফলে এটা অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা ধরুন, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ। আগে এটার কোনো সঠিক হিসাবই পাওয়া যেত না। এখন বিদ্যুৎ বিল কিংবা তিতাস গ্যাসের বিল—এগুলো সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট তথ্য পাই এবং এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই একটি দিকে আমাদের সুশাসনের অগ্রগতি হচ্ছে। এই ডিজিটাল ব্যবস্থাকে যদি আমরা সুদৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের প্রসার ঘটাতে পারি, তাহলে সুশাসনের আরও অগ্রগতি হবে।

প্রশ্ন :

জনপ্রশাসনের ডিজিটালাইজেশনেও স্বার্থান্বেষী মহলের বাধাবিঘ্ন, সময়ক্ষেপণের চেষ্টা ইত্যাদি আছে এমনটা শোনা যায়।

আকবর আলি খান: সুশাসন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা শুধু কম্পিউটার ব্যবহার করেই হবে না, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমাদের দেশে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত; কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়। তাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে এবং তার সঙ্গে ডিজিটাল ব্যবস্থা যুক্ত হলে সুশাসনের ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা সেসব ঘাটতি মিটিয়ে ফেলতে পারব বলে আশা করা যায়।

প্রশ্ন :

আমরা যে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সামরিক শাসনের মুখোমুখি আমরা আবারও হয়েছি; দুই দফায় আমরা সামরিক স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছিলাম। দ্বিতীয় দফায় আমরা স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিপুল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিলাম। আজ ৬ ডিসেম্বর সেই স্বৈরাচার পতন দিবস। তারপর ৩০ বছর চলে গেল; এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা আপনি কেমন দেখছেন?

আকবর আলি খান: যখন স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল, তখন আমরা খুবই উল্লসিত হয়েছিলাম; ভেবেছিলাম যে এবার বোধ হয় বাংলাদেশের মাটিতে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটল। কিন্তু আসলে তা ঘটেনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন না হলেও প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসন জারি হয়েছিল এবং তার যে ফলাফল, সেটা দেশকে ভোগ করতে হয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের এগোতে হবে, শুধু সামরিক শাসন এড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল, সেহেতু এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমস্যা দূর করতে পারি, এটাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নিয়ে আসতে পারি, এই সমস্যা অনেক কমে আসবে বলে মনে হয়।

প্রশ্ন :

কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো আরও দুর্বল হয়েছে। এমনকি আগে যে দ্বিদলীয় একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোটের ওপর ক্রিয়াশীল ছিল, শক্তিশালী সরকারি দলের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড ছিল, সংসদে অবস্থান ছিল, রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনের পর থেকে আমরা এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এ রকম অবস্থায় আমরা কী করে পৌঁছালাম?

আকবর আলি খান: আপনি যেসব কথা বললেন, সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে আমি একমত। আমিও মনে করি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে; কিন্তু দুর্বল হলেই যে আমাদের হতাশ হতে হবে, তা নয়। এর আগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও দুর্বল হয়েছে, কিন্তু জনগণের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক চেতনা আছে, তা বারবার জেগে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর আমার গভীর আস্থা রয়েছে। আমি মনে করি, তাদের এই প্রজ্ঞা আমাদের গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

কিন্তু সেই পথে যাত্রাটা কখন কীভাবে শুরু হতে পারে?

আকবর আলি খান: এটা সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাবে না। তবে এটা হবে, এটা আমার বিশ্বাস।

প্রশ্ন :

যেসব কারণে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, সেই কারণগুলো এখনো প্রবলভাবে আছে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিকদের অধিকার, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা—এসব ক্ষেত্রে আমাদের এখনকার অবস্থা বেশ খারাপ। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর পথ কী?

আকবর আলি খান: এটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ, কিন্তু আমি এতে হতাশ হই না। কারণ, ৮-১০ বছর সময় একটা জাতির জন্য খুব বেশি সময় নয়। সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাসের যে গণতান্ত্রিক চেতনা রয়েছে, সেটা পুনর্জাগ্রত হবে এবং আমরা অবশ্যই সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারব।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আকবর আলি খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।