প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান আছে

ডা. সারওয়ার আলী সংগীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে দেশের সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন-অনর্জন নিয়ে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

ডা. সারওয়ার আলী

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পাকিস্তান আমলে আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনগুলো যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তার কারণ কী বলে মনে করেন?

সারওয়ার আলী: পাকিস্তান আমলে যে দৃশ্যপটে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এখনকার দৃশ্যপট ভিন্ন। সে সময় রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ছিল জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক। জাতিসত্তাকে ধারণ করার ক্ষেত্রে সংস্কৃতি সাধারণভাবে প্রধান নির্ধারক। ধর্মও তার একটি উপাদান বটে। পাকিস্তানি শাসকেরা দ্বিজাতিতত্ত্বকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত হানে। যেমন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে বাধা দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় বেতারে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা। বিপরীতে আমরা লক্ষ করেছি, দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন। তাঁরা শাসকগোষ্ঠীর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছেন এবং রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নজরুলকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করলেও, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাঁকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন।

প্রশ্ন :

এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন কবে থেকে শুরু হলো?

সারওয়ার আলী: পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু। তবে তা সম্প্রসারিত হয় ষাটের দশকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপিত হয়, এরপর ওই বছরের নভেম্বরে ছায়ানট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মূলধারার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যত অগ্রসর হয়েছে, রমনার বটমূলে লোকসমাগমও তত বেড়েছে, একসময় সব শ্রেণির বাঙালির মিলনমেলা হয়েছে। প্রতি একুশের সান্ধ্য আয়োজনেও থাকত উপচে পড়া ভিড়। ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন, সংস্কৃতি সংসদসহ আরও বহু সংগঠন বাঙালি সংস্কৃতির আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। ১৯৬৯ সালে কামরুল হাসানের ‘অক্ষর বৃক্ষ’, শামসুর রাহমানের কবিতা ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ সেই ধারায় যোগ করে নতুন মাত্রা। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের গণহত্যার পর সশস্ত্র লড়াই শুরু হলে শিল্পীসমাজও তাতে যুক্ত হয়। শিল্পীরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেন। একই ধারা আমরা লক্ষ করেছি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রেও।

প্রশ্ন :

স্বাধীনতার পর সংস্কৃতির গণমুখী ধারা স্থবির হয়ে পড়ল কেন?

সারওয়ার আলী: সংস্কৃতি একটি চলমান বিষয়। স্বাধীনতার পর স্বাভাবিকভাবে সেই আরোপিত সংস্কৃতি আর থাকল না। আমরা নিজেদের সত্তাকে লালন ও বিকশিত করেছি।

প্রশ্ন :

আবহমান কাল থেকে বাঙালি তো সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি লালন করে এসেছে। তাহলে উগ্রবাদ এখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কীভাবে?

সারওয়ার আলী: বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতি দুই দিক থেকে আক্রমণের শিকার। একটি হলো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি। অপরটি আকাশসংস্কৃতি। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পাকিস্তানি আমলের মতো সংস্কৃতির স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করতে চায়। নিকট অতীতে আমরা এই সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র রূপ লক্ষ করেছি যশোরে উদীচীর সম্মেলনে, ২০০১ সালে রমনার বটমূলে। ইতিমধ্যে বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে এবং বৈশ্বিকভাবে উগ্রবাদ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঙালি সংস্কৃতি স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে গোষ্ঠীবিশেষ। এর সর্বশেষ নিদর্শন ভাস্কর্য বিষয়ে তাদের উসকানিমূলক মন্তব্য। ভাস্কর্য একটি উঁচু মানের শিল্পমাধ্যম। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর এই গোষ্ঠী বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। যেহেতু সামাজিক শক্তির জাগরণ ঘটানো যায়নি, সেহেতু রাষ্ট্র এই মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সমঝোতার নীতি অনুসরণ করেছে। সরকারের প্রশ্রয়ে এবং সমাজের নিষ্ক্রিয়তায় তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই বেড়ে গেছে যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সম্পর্কে অপব্যাখ্যা করে নতুনভাবে মাঠে নেমেছে।

প্রশ্ন :

দ্বিতীয় যে আক্রমণের কথা বললেন, সেটি কোথা থেকে এল?

সারওয়ার আলী: কয়েক দশক ধরে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিস্তৃতি ঘটেছে। এর ফল হলো উন্মুক্ত আকাশসংস্কৃতি। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ব্যান্ডসংগীতের প্রসার ঘটেছে। তবে ভরসার জায়গা হলো এই তরুণেরা যখন সংকটে পড়ে, তখন নিজস্ব সংস্কৃতির কাছেই আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে, টেলিভিশনে ভারতের হিন্দি সিরিয়াল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমি বলব, আকাশপানে তাকাতে দোষ নেই। তবে পদযুগল যেন বাংলার মাটিতে থাকে।

প্রশ্ন :

এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সারওয়ার আলী: বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি—দুটোই উল্লিখিত কারণে সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। যদি এসব অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চাই, তাহলে সংস্কৃতিকে অন্যতম প্রধান অবলম্বন করতে হবে। বহু বক্তৃতার চেয়ে একটি গান মানুষের হৃদয়ে দীর্ঘ সময় অনুরণিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমৃদ্ধ লোকসংগীত ও লোকজ সুরের গান নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো সব সংস্কৃতির কর্মীর লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। সেই উদ্যোগ আছেও। প্রতিবছর উচ্চাঙ্গ ও লোকসংগীতের আসরে বিপুল লোকসমাগম হয়।

প্রশ্ন :

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আপনারা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছিলেন, সেখানে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন কি?

সারওয়ার আলী: পাকিস্তান আমলে বাঙালি সংস্কৃতির লড়াইয়ে রাষ্ট্রচেতনা কাজ করেছে। পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে যে বাঙালির বিকাশ (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক) ঘটবে না, এই উপলব্ধি আমাদের ছিল। বরং আমি বলব, পাকিস্তানের প্রতি রাজনীতিকদের মোহভঙ্গ হয়েছে পরে। শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরাই জাতিসত্তার আন্দোলনকে আগে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দুইয়ের মধ্যে সংযোগ তো ছিলই। ছেষট্টি সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, সাতষট্টি সালে রমনা বটমূলে প্রথম নববর্ষের আয়োজন, উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।

প্রশ্ন :

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যে বাংলাদেশ দেখছেন, তা কি হতাশাজনক নয়?

সারওয়ার আলী: আশা-নিরাশার দোলাচলে আছি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান আছে। এই ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়েছে, মাথাপিছু গড় আয়, গড় আয়ু বেড়েছে, বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি—আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের যে চার মূলনীতি সংবিধানে স্থান করে নিয়েছিল, সমাজে ও রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসলাম ধর্মের যে উদার ও সমন্বয়ধর্মী ধারা প্রবহমান, তার জায়গায় স্থান করে নিল আমদানি করা নতুন ধারা এবং এর প্রকাশ আমরা বহুজনের জীবনধারায় লক্ষ করি। তবে আমি এ–ও মনে করি, হিজাব পরা নারীমাত্রই মৌলবাদী নন। শ্মশ্রুধারী পুরুষমাত্রই জঙ্গিবাদী নন। তাঁরা এসবকে ধর্ম পালনের অংশ মনে করেন। জঙ্গিবাদীদের মতো তাঁরা নিরীহ মানুষ হত্যা সমর্থন করেন না। বিরোধিতা করেন। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই সর্বজনের কাছে আহ্বান, মুক্তিযুদ্ধের যে ভাবাদর্শ ছিল, তার পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাঙালির মূলধারার সংস্কৃতি বড় অবলম্বন হবে। তেমনি দেশের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মানুষেরও নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশ অবারিত হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

শিক্ষা ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

সারওয়ার আলী: দেশে তিন ধরনের শিক্ষা আছে—সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ও মাদ্রাসাশিক্ষা। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আর ফেরে না (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে)। নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা সাধারণ শিক্ষা নিয়ে থাকে। মাদ্রাসাশিক্ষার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মাদ্রাসাশিক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও গণিত যুক্ত করতে হবে। আর শিক্ষার সার্বিক সংকট উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

প্রশ্ন :

নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? তারা কি সঠিক পথে আছে?

সারওয়ার আলী: আমি বাংলাদেশ, বিশেষ করে তরুণসমাজকে নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। আমাদের প্রজন্মের অহংকার আছে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে ইতিহাসের চাকা ঘুরে যায়। ফলে অনেকের মনে আশঙ্কা ছিল যে আমরা বোধ হয় একটি প্রজন্ম হারালাম। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ প্রমাণ করেছে, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার চেতনার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশে বর্তমানে যে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে, তার প্রধান চালিকা শক্তি এ দেশের তরুণসমাজই। তারা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। নানা নেতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও এই তরুণসমাজ একটি আধুনিক, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, মুক্ত চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নেবে, এটাই প্রত্যাশা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সারওয়ার আলী: আপনাকেও ধন্যবাদ।