বন্যা মোকাবিলায় নদীর শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে

ড. মো. মুনসুর রহমানছবি: প্রথম আলো

ড. মো. মুনসুর রহমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় পিএইচডি করেন, পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবেও পরিবেশসম্মত নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেন। নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাঁর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে ৩০টির ওপরে প্রকাশনা রয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আগের চেয়ে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

মুনসুর রহমান: বাংলাদেশের বন্যার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, উজান থেকে কী পরিমাণে পানি আসছে, দ্বিতীয়ত, কত গতিতে আসছে আর কত দিন ধরে সেই পানি বাংলাদেশে থাকছে। এই তিন দিক থেকেই এবারের বন্যা মানুষের জন্য বেশ ক্ষতিকর হয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারের বন্যাতেও মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে আসা পানি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। চীন ও ভারতের আসাম হয়ে এই নদটি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করেছে। চীনে কিছু অবকাঠামো থাকলেও ভারতীয় অংশ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত কোনো বড় অবকাঠামো নেই। গঙ্গা অববাহিকায় ফারাক্কাসহ অনেক অবকাঠামো আছে, সেগুলো পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধা দিচ্ছে। উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশ গভীর এবং পাড় ভাঙা বাড়ছে। শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে পলিগুলো তলদেশে জমা হয়ে ভরাট করে ফেলছে। এ দুই অববাহিকায় দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। বনভূমি ধ্বংস হয়ে কৃষিজমিতে পরিণত হচ্ছে। এতে বৃষ্টির পানি দ্রুত মাটির নিচে যেতে পারছে না। পানি ভূখণ্ড ধুয়ে আসা পলি নিয়ে দ্রুত নদীতে পড়ছে। এতে পলি নদীতে পড়ে তলদেশ উঁচু করে ফেলছে। ফলে নদীর বিভিন্ন স্থানে চর পড়ে চ্যানেল তৈরি হচ্ছে। নদীর স্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পাচ্ছে। ফলে দ্রুত পানি বেড়ে বসতি এলাকায় প্রবেশ করছে, ভাঙন বাড়ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় নদী খনন ও বাঁধ দেওয়াকেই মূলত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেগুলোর কার্যকারিতা কতটুকু বলে মনে করছেন?

মুনসুর রহমান: নদী খনন করে ও বাঁধ দিয়ে শাসন করা বেশ পুরোনো পদ্ধতি। সাদা চোখে এটি বন্যা মোকাবিলায় বেশ কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হয়। এ দুই কার্যক্রম নেওয়ার আগে আমরা পুরো অববাহিকার পানির পলির গতিবিধির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। আমরা ধরে নিয়েছি খনন করলেই নদীর গভীরতা বাড়বে, বন্যা কমে আসবে। নৌচলাচল সহজ হবে। কিন্তু কোথায়, কখন খনন করা হবে ও কীভাবে তা করা হবে, সেটা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে। নয়তো খননের পর নদী আবার ভরাট হয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কীভাবে তা করা উচিত?

মুনসুর রহমান: নদী খনন ও ব্যবস্থাপনার কাজটি অনেক সৃজনশীলভাবে করার সুযোগ আছে। যেমন ধরুন কিছু কিছু এলাকার নদীতে পড়া পলি সামান্য কেটে দিলেই নদীর পানি প্রাকৃতিকভাবেই বাকিটুকু কেটে নদীর তলদেশ গভীর করে ফেলবে। এ জন্য সারা বছর খননযন্ত্র বসিয়ে নদী খননের দরকার পড়ে না। নদীর এই স্বাভাবিক প্রবাহ ও প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে গভীরতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখি না। কোথায় কী পরিমাণে খনন করতে হবে, কীভাবে খনন করতে হবে, তা পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়া করা ঠিক হবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এ ব্যাপারে আমরা সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছি। তারা সেটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বন্যার অনেক উপকারী দিকের কথাও তো বলা হয়।

মুনসুর রহমান: তা তো অবশ্যই, বাংলাদেশে বন্যা না হলে এখানকার প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচানো যাবে না। প্রতিবছর আমরা যে পরিমাণে পানি ভূগর্ভ থেকে তুলি, বন্যায় আসা পানির মাধ্যমে তা পূরণ হয়। আবার বন্যার সঙ্গে আসা পলি আমাদের মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহ এবং পলি পড়ার ধরন পর্যবেক্ষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন, এখানে একেক নদীর পলির ধরন আলাদা। যেমন ধরেন সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোতে যে মাছ ও উদ্ভিদ জন্মায়, তা আপনি পদ্মা, মেঘনায় পাবেন না। কারণ, একেকটি নদীর প্রবাহ একেকটি পাহাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার মাটির ধরন, পানিতে থাকা খনিজ পদার্থের পরিমাণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। ফলে বন্যার সঙ্গে এসব প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর পদার্থ পানি ও পলির সঙ্গে এখানে আসে। পানির প্রবাহে যদি বাধা দেওয়া হয়, তাহলে পুরো অববাহিকার মানুষ এসব পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। সেগুলো বন্যার ক্ষতিকর দিকের সঙ্গে ভালো দিকগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বন্যার ক্ষেত্রে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়কে কীভাবে দেখেন?

মুনসুর রহমান: হ্যাঁ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫০টির ওপরে অভিন্ন নদী আছে। উজান থেকে আসা এই নদীগুলো বাংলাদেশের বন্যার পানির প্রধান উৎস। তিস্তা-গঙ্গাসহ বেশির ভাগ অভিন্ন নদীর উজানে বিপুল পরিমাণে বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আরও হবে আমরা জানতে পেরেছি। অভিন্ন নদীগুলো আগে যে পরিমাণে পলি নিয়ে আসত, তা এখন অনেক কমে গেছে। এসব অবকাঠামোর কারণেই তা হয়েছে। উজানে ভারত যেসব সব বড় অবকাঠামো নির্মাণ করছে, তার একটি বড় অংশ ২১০০ সালের মধ্যে শেষ হবে। সেগুলো চালু হলে পলি আসার পরিমাণ আরও কমে আসবে। এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, ৯০ শতাংশ পলি আসা কমে আসতে পারে। ফলে এর প্রভাব আমাদের নদ-নদীগুলোর ওপরে কতটুকু ও কীভাবে পড়বে, তার একটি মূল্যায়ন হওয়া দরকার। আগামী দিনের বন্যা ব্যবস্থাপনায় কোনো উদ্যোগ নিতে হলে ওই মূল্যায়ন ছাড়া এগোনো সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো নদী ব্যবস্থাপনায় আগামী ১০০ বছরের জন্য বদ্বীপ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সেখানে বন্যার বিষয়টি কীভাবে এসেছে?

মুনসুর রহমান: বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর চরিত্র আগামী ১০০ বছরের জন্য কোনো পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব নয়। এমনকি ৫০ বছরের জন্যও সম্ভব নয়। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী অববাহিকার সবকিছুই পরিবর্তনশীল। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো অনেকটা জীবন্ত সত্তার মতো। তাই এখানকার নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়টিও অনেক সৃজনশীল ও গবেষণানির্ভর হওয়া উচিত। কোনো পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে গেলে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ আরও বেড়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের উদাহরণ তৈরি করেছে। বন্যা মোকাবিলায়ও আমাদের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের।

মুনসুর রহমান: একদিক দিয়ে এটা ঠিক। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের মানুষের মৃত্যুর হার কমেছে। কিন্তু এখনো আমরা বন্যায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি কমাতে পারিনি। একই কথা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রেও বলা যাবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের জনসংখ্যার ঘনত্ব চীন, ভারত বা নেপালের চেয়ে অনেক বেশি। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজারের বেশি মতো মানুষ থাকে, ওই স্থানে তাদের অর্থনৈতিক তৎপরতাও আছে। ফলে এখানে যখন কোনো এলাকা ভাঙে বা প্লাবিত হয়, সেখানে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, অন্য দেশগুলোতে তার চেয়ে অনেক কম ক্ষতি হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশের বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।

মুনসুর রহমান: দেশের বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন ১৫ দিন আগের বন্যা পূর্বাভাস দিতে পারছি। কিন্তু এই পূর্বাভাস সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আরও কাজ করতে হবে। যেমন ধরেন আমরা বলছি, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠলেই বন্যা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আজ থেকে ৬০ বছর আগে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের যে এলাকার পানির উচ্চতা মাপা হচ্ছে, যমুনার পানি অন্য এলাকায় তার চেয়ে উঁচু হয়ে বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ছে কি না, তা আমরা কিন্তু হিসাব করি না। আর বন্যার পূর্বাভাস ও উচ্চতার হিসাবটি করা হচ্ছে কৃষিজমির জন্য। কিন্তু এখন দেশের বিভিন্ন নদীতীরবর্তী স্থানে প্রচুর পরিমাণে বসতি এলাকা, নগরায়ণ ও শিল্পকারখানা হচ্ছে। তাহলে বন্যা পূর্বাভাস আমরা কৃষিকে বিবেচনা করে দেব, নাকি শিল্প শহরকে বিবেচনা করে দেব, সেটি আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। আর দেশের উপকূলে যেমন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), তেমনি বন্যা সতর্কীকরণ কর্মসূচি (এফপিপি) থাকা দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বন্যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের কোন পদ্ধতিতে যাওয়া উচিত?

মুনসুর রহমান: বন্যা ব্যবস্থাপনায় আমাদের পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প খরচের সমাধানের দিকে যেতে হবে। সেই সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের গবেষকদের রয়েছে। ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনায় বিদেশি পরামর্শক বিশেষজ্ঞদের ওপরেই নির্ভর করেছি। কিন্তু আমাদের নদীগুলোর সম্পর্কে আমাদের এখানকার বিশেষজ্ঞরাই অনেক ভালো বোঝেন। তাঁদের সেই দক্ষতা এবং জ্ঞান রয়েছে। তাঁদের পরামর্শ নিয়ে এবং স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বন্যা ব্যবস্থাপনা করতে হবে। বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া ও প্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুনসুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।