বাজেটে অর্থ পাচারকে কার্যত উৎসাহিত করা হয়েছে

ড. মইনুল ইসলাম। অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব কেমন হলো, বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আর্থিক খাতের সংস্কার না থাকাসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাজেটে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ দেওয়া হলো। এ পদক্ষেপে কি পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসবে বলে মনে করেন?

মইনুল ইসলাম: প্রথমত, এ পদক্ষেপ কোনো দিন সমর্থন করি না। কারণ, এটা অনৈতিক পদক্ষেপ। এখন যারা বৈধভাবে অর্থ উপার্জন করছে, তাদের যে কর দিতে হয়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনলে এর চেয়ে কর কম দিতে হবে। বাজেটে কার্যত অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কালোটাকা সাদা করার আগে যে সুযোগ ছিল, এবার তা বিস্তৃত করা হলো। ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে বলে সরকার যে প্রত্যাশা করছে, তা–ও পূরণ হবে না। তবে পাচার হওয়া অর্থ বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়াতে পারে কিছুটা। কিন্তু এরপরও এমন অনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হয়নি।

বরং টাকা যাতে পাচার না হয়, সে জন্য বাজেটে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। পাচার হওয়া অর্থের বিশাল অংশ দুর্নীতি ও ব্যাংকঋণের টাকা। এখন পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ দেওয়ার অর্থ হলো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। আমরা সবাই জানি, পুঁজি পাচারের প্রধান গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো। এসব দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল পাঠিয়ে কারা পাচার করছে, তা জানা যেত। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের নামও বেরিয়ে আসত। পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখলাম না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়েই পণ্যের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬০ শতাংশে রাখার লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব কি?

মইনুল ইসলাম: মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতির যে হিসাব করা হয়, তাতে গলদ আছে। বর্তমানে সত্যিকারের মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে। আগামী বছর তা ৫ দশমিক ৬০ শতাংশে নামিয়ে ফেলা যাবে—এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সরকার যদি সত্যিকারের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়, সেটা কাজের কাজ হবে।

আমরা জানি, জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বাড়তি। আমাদের এখানে ডলারের সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত আন্তব্যাংক লেনদেনের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দরের পার্থক্য ৮ থেকে ১০ টাকা রয়ে গেছে। এই পার্থক্য কমাতে না পারলে ডলার–সংকট কাটবে না। ডলার–সংকট না কাটলে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না।

এখনকার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এবং বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয়ে উৎসাহিত করে এ ঘাটতি কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নিত্যপণ্যের পেছনে ব্যয় করে কুলাতে পারছে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে বাজেটের উদ্দেশ্য সফল হবে। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা শক্তিশালী নয়। যেমন প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাজেটে করপোরেট কর কমানোর পদক্ষেপ কীভাবে দেখছেন? প্রত্যক্ষ করের অবদান কমে যাবে?

মইনুল ইসলাম: এ বাজেটে উচ্চবিত্ত বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিনিয়োগকারীর নামে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। করপোরেট করের হার কমিয়ে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে এই কর কমানোর কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। না কমালে বাজেটের ঋণনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো যেত। করপোরেট কর কমানোর কারণে বিনিয়োগে খুব বেশি উৎসাহিত হবে বলে মনে হয় না।

এবার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের মাত্র ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা করপোরেট কর ও আয়কর থেকে আসবে। তাই ব্যক্তিগত আয়কর ও করপোরেট আয়কর থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রথম অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল। উন্নত দেশে যেতে হলে প্রত্যক্ষ করের অনুপাত বাড়াতে হবে। অথচ এখানে কমে গেছে। আরও দুঃখজনক হলো, মোট কর ও জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন।

বাজেটে যে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে, তা কমাতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক থেকে এত বেশি ঋণ নিলে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না। বিদেশি ঋণ কতটা নেওয়া যাবে বা নিলে তা শোধ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। মেগা প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছি, সেগুলো শোধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুই বছর পর আমাদের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে শুধু বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে বছরে চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ঋণের জন্যও অনেক বেশি অর্থ শোধ করতে হবে। করপোরেট কর কমিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে প্রত্যাশা ছিল বাজেটে। সেটি দেখা যায়নি। আপনি কীভাবে দেখছেন?

মইনুল ইসলাম: বাজেটে আর্থিক খাতের সংস্কারে তেমন কিছুই করা হয়নি। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো খেলাপি ঋণকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতাতেও আছে, ২ শতাংশ জমা দিয়ে ১৩ হাজার ৭০০ জন খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছেন। এটা কার্যত খেলাপি ঋণ লুকানোর পদক্ষেপ। এ কারণে চার লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থাকলেও দৃশ্যমান এক লাখ কোটি টাকার হিসাব দেখতে পাই আমরা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাজেটে খারাপ দিক কোনটি?

মইনুল ইসলাম: বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকে প্রথমবারের মতো জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এটা এবার ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এটা লুকানোর জন্য শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি যোগ করে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবারই জিডিপি অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে নামল। বিএনপি সরকারের আমলেও একবার ২ শতাংশের নিচে নেমেছিল। অথচ ইউনেসকো শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ ৬ শতাংশের ওপরে নেওয়ার কথা বলেছে। জিডিপির শতাংশ হিসাবে স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ বাড়েনি। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা দেখেছি আমরা। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য বাজেটে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল।

বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সময় আয়কর বাড়ানোর অগ্রাধিকার দেখতে পাইনি। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবেও তা নেই। দেশে ৭৫ লাখ ই–টিআইএন আছে। রিটার্ন দিচ্ছে মাত্র ২৫ লাখ। আর ২৫ লাখ মানুষের হদিস পাচ্ছে না এনবিআর। তাদের খুঁজে বের করে কর আদায় করা দরকার ছিল। এবারের বাজেটে এমন কোনো পদক্ষেপ পাইনি। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার; কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার ৪০ শতাংশ ব্যবহার করছি। তাহলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা উচিত। এতে ভর্তুকির চাপ বাড়ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাজেটে ভালো দিক কোনটি?

মইনুল ইসলাম: বাজেটে আমদানির বিকল্প শিল্পকে উৎসাহিত করার বিষয়টি ভালো দিক। রপ্তানিমুখী খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্যে শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে, তা–ও ইতিবাচক। আরেকটি ভালো দিক হলো, চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন চালু রাখা হয়েছে। তবে বড় কোনো নতুন মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। এটা এ সময়ের জন্য যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মইনুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।