ব্যর্থতার দায় সব শিক্ষককে নিতে হবে

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে ১৩ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর এক দিন ছাত্রলীগ হামলা চালায়। অবরুদ্ধ উপাচার্যকে মুক্ত করতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। সার্বিক বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর হিমাদ্রী শেখর রায়ের সঙ্গে।

প্রশ্ন :

ছোট একটা ঘটনা এত বড় হয়ে গেল! এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতা নাকি শিক্ষকদের ব্যর্থতা? কীভাবে দেখছেন?

হিমাদ্রী শেখর রায়: ঠিকই বলেছেন। ছোট একটা ঘটনা থেকে আজকের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আমার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রশাসনিক কাঠামো, তাদের অবশ্যই ব্যর্থতা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা শিক্ষকতা করছি, জ্যেষ্ঠ শিক্ষকসহ সব শিক্ষকেরই ব্যর্থতা আছে। আমরা কেন এই অবস্থায় যেতে দিলাম, আমাদের শিক্ষার্থীরা কেন এই আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হলো, সেটা আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের যেসব ভুল আছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনার আর মুখোমুখি না হতে হয় আমাদের।

প্রশ্ন :

শিক্ষকদের সামনেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাল। কিন্তু কোনো শিক্ষক তাঁদের রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন না। কেন?

হিমাদ্রী শেখর রায়: ওই দিন আমি নিজে ক্যাম্পাসে ছিলাম না। তবে সহকর্মীদের কাছ থেকে যেটুকু শুনেছি, পুলিশ আসলে অতর্কিত সেদিন আক্রমণটা করে। কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সেদিন অনেক শিক্ষক আহত হয়েছেন, অনেক শিক্ষার্থী তো আহত হয়েছেই, কর্মকর্তারাও আহত হয়েছেন। আসলে যেটা হয়েছে, পুলিশকে ঠিকমতো পরিচালনা করা হয়নি। আর শিক্ষকেরা এগিয়ে আসেননি, ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে যায়। আমার বিশ্বাস, যদি সব শিক্ষক ওখানে থাকতে পারতেন এবং ভূমিকা রাখতে পারতেন; তাহলে পুলিশি হামলা হতো না বা হতে দিতাম না। যেকোনো কারণেই হোক, এটা ঘটেছে এবং আমাদের কমবেশি ব্যর্থতা আছে।
আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন অথবা যেকোনো দাবি-দাওয়া আমাদের ধৈর্যসহকারে শুনতে হবে এবং শোনার পর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই পুলিশি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোনো সমস্যার নিরসন করা সম্ভব নয়। কারণ শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবি করে, অযৌক্তিক দাবিও করে। আমাদের উচিত হবে, তাদের যৌক্তিক দাবি শোনা এবং অযৌক্তিক দাবিগুলো শুনে তাদের বোঝানো ও আশ্বস্ত করা—যেগুলো আমাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাদের বয়সের একটা ধর্ম আছে, তারা অনেক সময় আবেগপ্রবণ হবে। পুলিশি হামলা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন :

চলমান আন্দোলনে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা দূরত্ব দেখা গেছে। বিশ্বাস আর আস্থার কেন এই সংকট?

হিমাদ্রী শেখর রায়: আমার ধারণা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। কোনো সম্পর্কের অবনতিও ঘটেনি। যে ব্যাপারটি হয়েছে, প্রশাসনিক পরিকাঠামোর প্রতি শিক্ষার্থীদের একধরনের অনাস্থা আছে, একধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। আমাদের যে প্রক্টরিয়াল বডি, আমাদের যেসব প্রভোস্ট বিভিন্ন হলের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা দেখেছি, যে ক্ষোভ এখানে তৈরি হয়েছে, সেটা এক দিনে তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা নয়। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভটা তৈরি হলো কেন!

প্রশ্ন :

শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনে বসলেন। কয়েক শ শিক্ষক তাঁদের অনশন থেকে সরে আসার অনুরোধ করলেও তাঁরা আস্থার অভাবে শিক্ষকদের কথা শোনেননি। পরে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে তাঁরা অনশন থেকে সরলেন। কী বলবেন এ বিষয়ে?

হিমাদ্রী শেখর রায়: আমাদের শ্রদ্ধেয় সহকর্মী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার যখন এলেন এবং শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করলেন অনশন ভাঙানোর জন্য; তাঁর কথা শিক্ষার্থীরা শুনেছে। আমরা খুবই খুশি হয়েছি এই ভেবে, কারণ আমরা খুবই কষ্টে ছিলাম। আমরা যখন গিয়েছিলাম, আসলে আমরা ওখানেও একটু দেরি করে ফেলেছি। শিক্ষক সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পদে আছি; আমাদের সবাইকেই এই দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা তাদের এই আমরণ অনশনে যেতে দিলাম কেন, আমি আবারও বলব, এটা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের ঘাটতি ছিল, আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল, আমাদের সমন্বয়হীনতা ছিল। আমরা প্রশাসন এবং সব শিক্ষক মিলে যদি মনেপ্রাণে চাইতাম, তবে এই সমস্যা অনেক আগেই এড়ানো সম্ভব হতো।

প্রশ্ন :

আমরণ অনশন থেকে সরে এলেও শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এখনো আন্দোলন করছেন। সংকট কীভাবে কাটবে বলে মনে করেন?

হিমাদ্রী শেখর রায়: শিক্ষার্থীরা অনশন-অবরোধ তুলে নিলেও তারা ঘোষণা দিয়েছে, তারা এক দফা দাবিতে আন্দোলনে আছে। আসলে সরকার এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে কেউই বিব্রত না হয়। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে অতি দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেবে, যেখানে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে।
শুধু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি একধরনের বার্তা দিয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, যেকোনো সমস্যা যখন তৈরি হবে, আমাদের ধৈর্যসহকারে সমস্যাগুলো শুনে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দিকে যেতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের মধ্যে যদি অহংবোধ কাজ করে, সেটা ঠিক হবে না। প্রশাসনের যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেককে সহনশীল আচরণ করতে হবে, শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে হবে। শিক্ষার্থীরা আমাদেরই সন্তান।
এটা ঠিক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণও কিন্তু মাঝেমধ্যে শালীনতার বাইরে চলে যায়। আমাদের কথাবার্তা, চালচলনে আরও যত্নবান হতে হবে। জাতির সামনে যেন আমরা ভুল বার্তা না দিই। কেউ যেন না বলতে পারে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কেন এমন আচরণ করছেন? আত্মসমালোচনা করতে হবে।