রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি করছে

মো. রহমত উল্লাহ
অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি, আইন অনুষদের ডিন ও সিন্ডিকেটের সদস্য। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিস্থিতি, মান ও সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি। এবারের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়েছে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া। জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনের প্রভাব কি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও পড়ল?

রহমত উল্লাহ: যাঁরা এবার শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে অংশ নেননি, তাঁরা কিন্তু এ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকে নির্বাচন না করার পক্ষে ছিলেন। তবে কেউ নির্বাচন বর্জন করেননি। আমাদের নীল দলের মনোনয়ন ঠিক হয়েছে অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে। ফলে আমাদের একধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আপনি দেখবেন যে সাত বছর ধরে নীল দল শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে যাচ্ছে। সেদিক থেকে দেখলে আমাদের নির্বাচিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখন আমরা চেষ্টা করছি গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে। শিক্ষকদের স্বার্থ নিশ্চিত ও শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল করার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পড়ছে। আপনি আইন অনুষদের ডিন। আইন বিভাগের বয়সও শত বছর হতে যাচ্ছে। শতবর্ষী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদানকে কীভাবে দেখেন?

রহমত উল্লাহ: ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঔপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা অবকাঠামো। এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রেখেছে। এ দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা বিলিয়ে গেছে, মানবসম্পদ তৈরি ও উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল এক–দুজন, সেখানে আজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। নারী জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অসামান্য। এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম—সব ক্ষেত্রেই এর ভূমিকা রয়েছে। বলা যায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বিকাশ ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।

প্রশ্ন :

শতবর্ষ এমন একটি মাইলফলক, যখন আত্মমূল্যায়ন বা আত্মসমালোচনার বিষয়টি জরুরি। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকার কথা বললেন, তা কি বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় রাখতে পারছে?

রহমত উল্লাহ: কালের পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন যেখানে এসেছে, তাতে এটা মানতেই হবে যে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। শতবর্ষের বিভিন্ন পর্যায়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা বদলে গেছে। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারত, আজ তা দিতে পারছে না। একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক চাপ নিতে হয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে জাতির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ঘাটতি দেখা গেছে। তবে এখন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমাচ্ছে। কিন্তু এরপরও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন :

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত কারার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। আপনি কোথায় কোথায় সমস্যা দেখেন?

রহমত উল্লাহ: শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি বাধা। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো জরুরি। বিভাগগুলোকে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেগুলোকে তার মূল ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। এখন ইনস্টিটিউট ও বিভাগগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইনস্টিটিউটগুলোর শুধু মাস্টার্স আর এমফিল ডিগ্রি দেওয়ার কথা। তা ছাড়া কিছু বিভাগকে যেখানে এক করা প্রয়োজন, সেখানে বিগত সময়ে সেগুলোকে ভাগ করে নতুন বিভাগ তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও সমস্যা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ও বার্ষিক পদ্ধতির পরীক্ষা, দুটিই কার্যকর রয়েছে। এগুলো বড় সমস্যা তৈরি করছে। শিক্ষা উপকরণ, পরিবেশ ও অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের তুলনায় নগণ্য। সিটের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকেন, তা আপনারা সবাই জানেন।

প্রশ্ন :

যে সমস্যাগুলো আপনি চিহ্নিত করলেন, তা নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট অনেকের জানা। এগুলো দূর করবে কে? করার পথ কী?

রহমত উল্লাহ: আমি মনে করি, এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন একটি দায়িত্বশীল ও লক্ষ্যমুখী প্রশাসন। ভিশন ও মিশন ঠিক করে এগোতে হবে। বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নেওয়ার চেয়েও বড় কাজ হচ্ছে জাতীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা রাখবে, তা ঠিক করা। উন্নয়ন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের একাডেমি ক্যালেন্ডার করা হয়, কিন্তু তা মেনে চলা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় আইন কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয় না। আমরা নানা ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করি, সাংঘাতিক অনিয়মকে গ্রহণ করি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির পথে বড় বাধা।

প্রশ্ন :

আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে যে সমস্যার কথা বললেন, তার কারণ কি রাজনৈতিক প্রভাব?

রহমত উল্লাহ: রাজনৈতিক প্রভাব একটি পুরোনো সমস্যা। রাজনৈতিক ক্ষমতা সব সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করার চেষ্টা করেছে। এ বাস্তবতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি করেছে। বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই দায়ী। শিক্ষকদের রাজনৈতিক আদর্শ থাকতে পারে। পেশাদারি মনোভাব ও শিক্ষকতাকে অগ্রাধিকার দিলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বরাদ্দ এমনিতেই কম। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা সামান্য অর্থও ব্যয় করা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার প্রতি এ অনীহা কেন?

রহমত উল্লাহ: গবেষণার জন্য বরাদ্দই থাকে না। আমরা তো গবেষণার অর্থের জন্য হাহাকার করি। আপনি যে অভিযোগ করলেন, তা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি তহবিল রয়েছে। একটি নিজস্ব আয় ও অন্যটি সরকারি বরাদ্দ। এখন এ দুটিকে এক করে ফেলা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব তহবিলের অর্থ হিসেবে নিয়ে সরকার বাজেট বরাদ্দ করে। সেই বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। নিয়মিত পড়াশোনার খরচেই সেই অর্থ চলে যায়। গবেষণার জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। জাতীয় পর্যায়ে আমরা সব সময় শুনে আসছি যে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু শিক্ষা বা গবেষণায় বরাদ্দের সময় অর্থের ঘাটতি দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। দেখা যায়, শিক্ষাসংক্রান্ত পরিকল্পনায় শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই। যাঁরা এসব দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা প্রশাসনিক দৃষ্টিতে বিষয়গুলো দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করতেই যেন বেশি আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও ঘাটতি রয়েছে। ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রসারের নামে ভারাক্রান্ত করেছে। যেখানে খরচ করার কথা, সেখানে না করে করা হয়েছে ভিন্ন খাতে। লোক নিয়োগ করা হয়েছে বেশি। অনেকে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলেছে। উন্নয়নের নামে স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

প্রশ্ন :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি অতীতে বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সব ধরনের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এখন শিক্ষক সমিতিকে রাজনৈতিক বিবেচনা অনুযায়ী অবস্থান নিতে দেখা যায়। বলা যায়, সরকারকে খুশি করার চেষ্টা থেকে অনেক অবস্থান নেওয়া হয় এবং অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া হয়।

রহমত উল্লাহ: দলীয় রাজনীতির কুফল হিসেবে অনেক কিছুই চেপে বসেছে। শিক্ষক সমিতিকে কমিটির সবার মত নিয়ে অবস্থান নিতে হয়। ভিন্নমত পোষণকারীদের টার্গেটে পরিণত করা হয়। অদৃশ্য প্রতিকূলতায় পড়তে হয়, ফলে অনেকে ভয় পান সাহস করে কিছু বলতে। এ পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। যথাযথ ভূমিকা ও অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে সমিতির যে ভূমিকা পালন করা উচিত, বাস্তব পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা করা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা দূর করার পথ কী?

রহমত উল্লাহ: আমি মনে করি, বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তবে আমলাতন্ত্র নির্ভর না করে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট লোকজনকে নিয়ে এ কমিশন গঠন করতে হবে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো অবকাঠামোগতভাবে একধরনের মান বজায় রাখতে পারলেও যোগ্য শিক্ষকের সংকট প্রকট। এখন সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা এক করা হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, ঢাকার বাইরের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় থাকা উচিত। ভালো শিক্ষক ও প্রয়োজনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যেন কিছু সময়ের জন্য সেখানে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা উচিত। একই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিধিবিধানের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় থাকা উচিত। এক দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে চলতে পারে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ

রহমত উল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।