রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা কোনোটাই সুষ্ঠু ধারায় অগ্রসর হয়নি

আবুল কাসেম ফজলুল হক। শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক। তাঁর রচনা স্বদেশভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তায় ঋদ্ধ। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য, এর অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান মনোজ দে

আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় এ দেশের মানুষ যে প্রাণ দিয়েছে, তা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের পর আসামের বাঙালিরাও বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু ৭০ বছরেও আমরা সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারলাম না কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ প্রশ্ন দেশভাগের আগেই উঠেছিল। ১৯৪৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরেই তমদ্দুন মজলিশ গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। তমদ্দুন মজলিশ পাকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতর রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নটি সামনে আনে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এ সংগঠনের মধ্যে ছিল না। পাকিস্তানকে রক্ষা করার এবং গড়ে তোলার জন্যই এ সংগঠন বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতর রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিল। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল মতিন বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন, আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক প্রক্রিয়ারও সূচনা করেন। পরে তিনি পরিচিত হন ‘ভাষা মতিন’ নামে। তিনি ছিলেন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। তখন গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এ সংগঠনও অন্যতর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে অগ্রসর হয়। সংগঠনটির পেছনে সক্রিয় ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টি। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগের নাম তখন ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের কিছু পরে গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র ইউনিয়নের পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টি। সে পর্বে বাংলাকে অন্যতর রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার দাবির সঙ্গে জনজীবনের আরও নানা দাবি আন্দোলনের কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয়। শ্রমিক-কৃষকদের নানা সমস্যা, ছাত্রদের নানা সমস্যা, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি ইত্যাদি সামনে আনা হয়। তবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি এবং গণতন্ত্রের দাবি সব সময় উত্থাপিত হয়েছে। রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রগতিশীল চিন্তাধারা নিয়ে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরাও সক্রিয় ছিলেন। তথ্যাদি বিচার করতে গেলে দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর্যায়ে বাংলা ভাষার, বাংলা সাহিত্যের এবং বাংলায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বছর পাঁচেকের মধ্যেই সরকারি অফিসে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে এবং সে ধারা চলমান আছে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের জন্য অনেক বই ইংরেজি থেকে—আরও কোনো কোনো ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। অনেক বই লিখিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, প্রভৃতি বিষয়েও বাংলা প্রচলনের আয়োজন দেখা গেছে। বিচারব্যবস্থারও বাংলা প্রচলনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকের কাজকর্মেও বাংলা চালু করার জন্য প্রচার-আন্দোলন চালানো দরকার। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্র সৃষ্টির পাশাপাশি সমালোচনা ও মূল্য বিচার দরকার। গত ৭০ বছরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও উপযোগিতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার উন্নতি নিয়ে, জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠন নিয়ে যে আগ্রহ ও আশা আগে ছিল, অন্তত ২০ বছর ধরে তা কমে যাচ্ছে! কেন কমে যাচ্ছে। ভাষা, জাতি ও রাষ্ট্র কোন গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে? এসবই আজকের প্রশ্ন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু করা। কিন্তু এখন শিক্ষায় বাংলা ভাষাটাই বেশি অবহেলিত।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা এখন অবহেলিত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন চালু করা হয়েছে এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে মূলধারার শিক্ষাকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে। ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুযায়ী বাংলাদেশে ও-লেভেল, এ-লেভেলে পড়ানো হচ্ছে। এসবের দ্বারা বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন কমছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার জন্য এনজিও মহল এবং সরকার কাজ করছে। এর সুফল কী হচ্ছে, কী হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বলা হচ্ছে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতির জন্য কিছু করা হচ্ছে বলে মনে হয় না।

পাকিস্তানকালে বাংলা উচ্চারণ বোর্ড নামে যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল, ১৯৭২ সালে সেটি বিলুপ্ত করা হয়। আমি মনে করি, সেটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উন্নতির জন্য নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমও অপরিহার্য। আমি বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করা উচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইংরেজির অপরিহার্যতা আছে। ভালোভাবে ইংরেজি শেখানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার। সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন করে, জনসমর্থন নিয়ে তার বাস্তবায়ন দরকার। জাতীয় জাগরণ দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে যে জাগৃতি তৈরি করেছিল, অনেকের মতে তার যৌক্তিক পরিণতি স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা তার মর্যাদা রক্ষা করতে পারল না কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের মধ্য দিয়ে যে সংগ্রামী চেতনার বিকাশ ঘটে, তার ধারাবাহিকতায়ই ঘটেছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটেছিল গণজাগরণ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বছর দশেকের মধ্যেই সেই গণজাগরণ শেষ হয়ে যায়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দুর্বল, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাও দুর্গতির মধ্যে আছে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা দুটো সম্পর্কেই নতুন চিন্তা ও নতুন জাগরণ দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশে রয়েছে কয়েক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। সাধারণ ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন ও মাদ্রাসাশিক্ষা। এটা বাংলা ভাষার চর্চায় অন্তরায় কি না?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: অবশ্যই এ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি বাংলা ভাষার উন্নতির পথে অন্তরায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে নানা ধারায় বিভক্ত রাখার ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থা জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের প্রতিকূল। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতটা গড়ে উঠেছে, ভেবে দেখা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। এ দেশেও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু আমরা দিবসটির তাৎপর্য মর্মে কতটা ধারণ করতে পেরেছি?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর আমাদের রাষ্ট্রভাষার লক্ষ্য এক নয়। ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের লক্ষ্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করা। বাংলা ভাষা বিলীয়মান নয়, বিকাশশীল। আমাদের উচিত ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ রূপে পালন করা এবং রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র দুটোকেই যথাসম্ভব উন্নতিশীল রাখা। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তার স্বরূপ বুঝে আমাদের জনজীবন, জাতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলা দরকার। নতুন রাজনীতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন উপলব্ধি দরকার। বিশ্বায়নের নামে বৃহৎ শক্তিগুলো ও বিশ্বব্যাংক মানবজাতিকে যেভাবে চালাচ্ছে, তার পরিবর্তন দরকার। এসব নিয়ে পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই গুরুতর আলোচনা-সমালোচনা দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও জনজীবনের সব স্তরে বাংলা চালু করা। কিন্তু আমরা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছি। উচ্চ আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্র ও জনজীবনে বাংলা ভাষার প্রচলন অনেকটুকু হয়েছে। বিচারব্যবস্থায়ও বাংলা প্রচলনের কাজ চলছে। বড় কথা হলো বাংলাদেশের উচ্চশ্রেণির লোকেরা এখন বিদেশমুখী এবং তারা বাংলা ছেড়ে ইংরেজির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কেবল রাজত্ব করতে চাইছে; জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠন নিয়ে খুব কমই ভাবছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলা ৩০ কোটি মানুষের ভাষা। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না। বাংলার চেয়ে কম জনসংখ্যার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বেশি। যেমন আরবি, স্প্যানিশ, ফরাসি ইত্যাদি। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণ আছে বলে মনে করেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: ৩০ কোটি মানুষ এক জাতি ও এক রাষ্ট্রের মধ্যে নেই। বিভাজনের ফলে তারা দুর্বল। তবে বাংলাদেশের বিরাট বিপুল সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ যদি জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উন্নতিশীল হয়, তাহলে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সব দিক দিয়েই দুনিয়ার সামনে আদর্শ হয়ে উঠবে। আমাদের প্রধান দুর্বলতা রাজনীতিতে। রাজনীতিকে উন্নত করা গেলে সবকিছুই উন্নতির দিকে চলবে। আমাদের চিন্তা দরকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতির উপায় নিয়ে। একটি বৌদ্ধিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা আরম্ভ করা সমীচীন। আমি বৌদ্ধিক আন্দোলনের কথা বলছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা আন্দোলন এ ভূখণ্ডের মানুষের মানস গঠনে কতটা ভূমিকা রেখেছে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জনমনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই চেতনা বিকশিত হতে হতে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বছর দশেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে এ দেশে গবেষণা কম ছিল। তবে সে সময়ের গবেষণায় আন্তরিকতা ছিল। আন্তরিকতার সঙ্গে যোগ্যতার সংযোজনে কাজ মূল্যবান হয়েছে। এখন গবেষণা অনেক বেশি হচ্ছে। এগুলোর মর্মে সর্বজনীন কল্যাণবোধ ও আন্তরিকতা কম দেখা যায়। নানা রকম লাভ-লোভ কার্যকর থাকছে এসব গবেষণায়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিশ্বায়নের যুগে অর্থনীতিই ভাষা ও শিল্প-সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের ভাষার ভবিষ্যৎ কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়। বাংলা ভাষাও সম্ভাবনাময়। প্রয়োজন মেটানোর মতো সবকিছু বাংলাদেশের আছে। লোভী লোকজনের নেতৃত্বে অভীষ্ট সার্বিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির উন্নতি দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা বাংলা। সেখানে হিন্দির আধিপত্য সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। এর কারণ কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: এর কারণ কলকাতার বৌদ্ধিক ঐতিহ্য। ঢাকা সে রকম বৌদ্ধিক ঐতিহ্য এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে কলকাতার ঐতিহ্যকে ঢাকার ঐতিহ্য রূপেও গ্রহণ করা উচিত। কারণ, তখনকার রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় কলকাতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আমরাও অংশীদার ছিলাম। বাংলা ভাষার অতীতের সব সৃষ্টিই আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু—এঁরা তো আমাদের ঐতিহ্যেরও অন্তর্গত। আগেকার মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ইত্যাদিও আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অপরিহার্য।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে রাষ্ট্র যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাবিদ ও গবেষকেরাও কি তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্রীয় অবস্থার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা প্রতিকূল হলে জ্ঞানচর্চায় অল্পই অগ্রসর হওয়া যায়। শিক্ষা ও গবেষণায় এর প্রভাব পড়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশের মতো সংগঠন সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। পরবর্তীকালে ধর্মভিত্তিক কোনো দল বা সংগঠনকে সেই ভূমিকায় পাইনি।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: তমদ্দুন মজলিশ ও খিলাফতে রব্বানী ইসলামের যে ব্যাখ্যা দিত, তা বহুলাংশে সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনেরই অনুকূল ছিল। তখনকার মূল স্পিরিটই ছিল সেক্যুলারিজমের অনুকূল। একমাত্র মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ও জিহাদের পথ ধরে চলার। ধর্মের কথা বা মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা বললেও অনেক দল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে না। ধর্ম ও আদর্শ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা দরকার। প্রায় ৪০ বছর ধরে অনেক ভুল কাজ করা হয়েছে। তার ফলে পুরোনো সংস্কার—বিশ্বাস ও ধর্মের পুনরুজ্জীবন দেখা যাচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বলা হয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এ দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সেই চেতনা। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র বাঙালির বাইরের জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় তেমন ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারল না কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সবকিছুই বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়। ফলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা কোনোটাই সুষ্ঠু ধারায় অগ্রসর হয়নি। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রায় সবাই কামনা করেন। পরিবর্তন ও অবস্থার উন্নতি অবশ্যই হবে। নৈতিক সচেতনতা দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আপনাদেরও ধন্যবাদ।