শাসকগোষ্ঠীর মনোজগৎ বদলাতে হবে

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সাময়িকী সর্বজনকথার প্রকাশক। শিক্ষকতার বাইরে তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতি, উন্নয়ন রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, তরুণ প্রজন্ম ইত্যাদি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার মূল সংকটটা কী?

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: সংকটটা হলো আমাদের রাজনৈতিক শাসনের দুর্বলতা এবং রাষ্ট্র বেদখল হয়ে গেছে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-আমলা-গণমাধ্যম বন্ধনে। আমরা যদি সংবিধানের চার মূলনীতিকে মাপকাঠি ধরি, তাহলেও বলতে হবে ৪৯ বছর ধরে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। যদি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ভিত্তি ধরি, দেখব আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র না করে বিযুক্তিমূলক রাষ্ট্র তৈরি করেছি। আমাদের ঘোষিত জাতীয়তাবাদের বাইরে থেকে গেল পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আছে। কিন্তু এর জন্য যে চর্চা ও অনুশীলন দরকার ছিল, সেটি হয়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রের জগাখিচুড়ি চরিত্র আরও পাকাপোক্ত করা হলো। এর নাম দেওয়া যায় ‘অর্গানাইজড হিপোক্রেসি’। সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়ছে খুব অমানবিকভাবে।

প্রশ্ন :

এর দায় কি কেবল রাষ্ট্রের? সমাজের অগ্রবর্তী অংশ তথা শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের কোনো দায় নেই?

তানজীমউদ্দিন: অবশ্যই আছে। রাষ্ট্র তো একা একা বিরাজ করে না। তবে এ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের শূন্যতা বা অভাব তৈরি হয়েছে একাত্তরেই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে, তাঁরা কিন্তু সেই সময়ের রাজনৈতিক স্রোতোধারার মানুষ ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ভিন্ন চিন্তার মানুষ। তাঁদের শূন্যতা পূরণ করার জন্য যে স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা থাকা দরকার, রাষ্ট্রকাঠামো শেষ পর্যন্ত ওভাবে বিকশিত হতে দেয়নি। তবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীরা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। জ্ঞানচর্চা, চিন্তায় দায়বদ্ধতার প্রমাণ রেখেছিলেন তাঁরা অনেকাংশে। কারণ, তখন দলীয় পরিচয় বড় ছিল না। সবাই এক হয়েছিলেন স্বৈরাচারকে হটাতে। কিন্তু এরশাদের পতনের পর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও দ্বিদলীয় সুবিধাবাদী চিন্তা আসে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, তাদের সমর্থক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন পদে বসাল, সুযোগ-সুবিধা দিল। এর ফলে বুদ্ধিজীবীদের মনোজগতের স্বকীয়তা আর থাকল না। তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা আকাশচুম্বী হয়ে গেল।

প্রশ্ন :

এই দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরেও তো বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ আছেন, তাঁরা কী করলেন?

তানজীমউদ্দিন: তাঁদের মূল সমস্যা হলো মূলধারায় আসতে পারছেন না। এর পেছনে সংবাদমাধ্যমেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমও দলীয় বৃত্তের বুদ্ধিজীবীদের প্রচারই বেশি দিয়ে থাকে। এর বাইরের বুদ্ধিজীবীরা তেমন গুরুত্ব পান না। সংবাদমাধ্যমেও করপোরেটাইজেশন ঘটেছে। ফলে নব্বইয়ের পরে সংবাদমাধ্যমও আগের চরিত্র ধরে রাখতে পারছে না। সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ভারসাম্য রক্ষা অথবা সরকারবান্ধব এবং সরকারের প্রচারণাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :

কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ভিন্নমতের বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে সংবাদমাধ্যম বেশি ঝুঁকিতে আছে?

তানজীমউদ্দিন: শাসকগোষ্ঠী নিজের অবস্থান সংহত করতেই এ কৌশল নিয়েছে। তঁারা ভালো করে জানেন যে সংবাদমাধ্যমকে চাপে না রাখতে পারলে ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকতে পারবেন না।

প্রশ্ন :

স্বৈরাচারের পতনের ৩০ বছর পার হলো। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ হয়েছে?

তানজীমউদ্দিন: এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় মানুষের মধ্যে বিরাট আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। নেতা-নেত্রীদের কথা শোনার জন্য মানুষ রেডিও-টিভির সামনে, জনসভায় ভিড় জমাতেন। তঁারা আশা করেছিলেন, একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবে। কিন্তু নব্বইয়ের পর যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা সেই স্বৈরাচারী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটি রেখে দিয়েছেন। তারই শেষ পরিণতি হলো ‘ডেভেলপমেন্টাল অটোক্র্যাসি’ বা উন্নয়ন–আড়ালি স্বৈরাচারী সরকারকাঠামো।

প্রশ্ন :

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করে স্বায়ত্তশাসন আদায় করেছিলেন, এখন কী অবস্থা?

তানজীমউদ্দিন: স্বায়ত্তশাসন এখন আয়ত্তশাসনে পরিণত হয়েছে। যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন আছে, তাদের নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা অস্থিরতায় ভোগেন। এ কারণে তাদের প্রথম কাজ হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করা। সরকার তঁাকেই উপাচার্য নিয়োগ করে, তাদের প্রতি যাঁর নিঃশর্ত আনুগত্য আছে। আবার উপাচার্য এমন লোকদের প্রশাসনে বসান, যঁারা তাঁর প্রতি শতভাগ অনুগত হবেন।

প্রশ্ন :

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

তানজীমউদ্দিন: সরকার যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের শত্রু না ভাবে, তাহলে স্বাধীন চিন্তা বিকশিত হতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। সরকারের মানসিকতা এবং মনোজগৎ পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হতে হবে। মুক্তচিন্তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যা হলো আমাদের সরকারব্যবস্থা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চায় না। দেখতে চায় অনুগত প্রজা হিসেবে। যাঁরাই ক্ষমতাসীন হচ্ছে, তাঁরাই এ কাজ করেন।

প্রশ্ন :

সম্প্রতি বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান সবার নিচে।

তানজীমউদ্দিন: এটা খুবই দুঃখজনক। এ সূচক মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব মহান শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ বলে মনে করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির জন্য যে বিনিয়োগ দরকার, রাষ্ট্র কখনো তা করে না। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের বাজেটের চেয়েও কম। প্রাথমিক পর্যায়ের বনিয়াদি শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের যে চরম অবহেলা, তার খেসারত আমরা দিচ্ছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার বনিয়াদটাই দুর্বল। উপযুক্ত শিক্ষার্থী তৈরি করতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের ওপর।

প্রশ্ন :

আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখছেন কি?

তানজীমউদ্দিন: আগেই বলেছি, এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোজগতে পরিবর্তন আনা জরুরি। নেতৃত্বের গুণগত মান ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই পড়ে। তাদের রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক কী হবে, রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক কী হবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। রাষ্ট্রের সব নাগরিককেই ধারণ করতে হবে তাকে। কেবল দলের লোককে ধারণ করলে হবে না। আমাদের নেতাদের মধ্যে বিযুক্তীকরণের যে ব্যাধি চেপে বসেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশটি সব মানুষের, সর্বজনের।

প্রশ্ন :

হেফাজতে ইসলামসহ অনেক ইসলামি সংগঠন ভাস্কর্য ইস্যুতে মাঠে নেমেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

তানজীমউদ্দিন: এটাও একধরনের চাতুর্যের রাজনীতি, মূল্যবোধহীন রাজনীতির প্রকাশ। জামায়াতকে মোকাবিলা করতে আওয়ামী লীগ হেফাজতকে কাছে টেনে নিয়েছিল। অতীতেও ‘রাজনৈতিক কৌশল’–এর অজুহাতে তারা জামায়াতকে সঙ্গে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছিল। বিশেষ করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। সে সময় আমার দেশ পত্রিকাটি ধর্ম রক্ষার নামে হেফাজতকে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে তাদের অনেক দৃশ্যমান এবং জনপ্রিয় করে তোলে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে জামায়াত রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপে নতুন করে পড়ে যাওয়ার কারণে বিএনপি হেফাজতকে ব্যবহার করে ক্ষমতা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল। সেই চেষ্টা যখন সফল হলো না, তখন সরকার ও হেফাজতের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয়। পাঠ্যপুস্তকে প্রগতিশীল লেখক, কবিদের লেখা বাদ দেওয়া, কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের প্রতি রাজনৈতিক তোষণ নীতি নিশ্চিত করে সরকার। আমি মনে করি, তারই চূড়ান্ত পরিণতি এ ভাস্কর্যবিরোধিতা। আমার ধারণা, এর মধ্য দিয়ে হেফাজত আরেকটি দর–কষাকষি করবে, আরও বেশি ছাড় পাবে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যটা দেখুন। অন্য কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকেই গ্রেপ্তার করে। কিন্তু হেফাজতের প্রতি তাদের সুর অনেক নরম, অনেক সহিষ্ণুতা।

প্রশ্ন :

তাহলে আপনি বলতে চান বাংলাদেশের কোনো সম্ভাবনা নেই?

তানজীমউদ্দিন: বরং আমি বলি বাংলাদেশের মানুষের শক্তি অপার। এ শক্তিই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রমাণ আমরা সব সময় পেয়ে আসছি। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অনেক অর্জন আছে। অর্জন আছে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ক্রীড়াঙ্গনসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে। ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। শুধু রাজনীতিবিদদের মনোজগৎ বদলালে বাংলাদেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে খুব সহজে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ

তানজীমউদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ