শুধু সরকারি নয়, সব বাসেই হাফ পাস থাকতে হবে

মোজাম্মেল হক চৌধুরী। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব। দেশের ১৭টি জেলা ছাড়াও বেশ কিছু উপজেলায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির শাখা আছে। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন গণপরিবহনের যাত্রীদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে। আলোচনায় আসে সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়ক ও হাফ পাসের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নিরাপদ সড়ক ও হাফ পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন করছে। প্রথমে হাফ পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলেও পরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান মারা গেলে আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ করে। পুরো বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: সড়কে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। একদিকে ছাত্ররা হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। দুটোই যৌক্তিক দাবি। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে, তখন ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা। কিন্তু তাদের এখন রাস্তায় আন্দোলন করতে হচ্ছে। এটি দেশের অপূরণীয় ক্ষতি। সরকারের উচিত দ্রুত সমস্যাটির সমাধান করা। নিরুপায় হয়েই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রাষ্ট্রমালিকানাধীন গণপরিবহন বিআরটিসি তো ছাত্রদের হাফ পাসের দাবি মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে বাসমালিকেরা বলেছেন, তাঁদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তাঁরা ফের ধর্মঘটে যাবেন।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: কেবল সরকারি বাস কেন, বেসরকারি বাসমালিকদেরও হাফ পাসের দাবি মেনে নেওয়া উচিত। ভাড়া নির্ধারণের সময় শহর ও শহরতলি এলাকায় ৭০ শতাংশ আসন ভর্তি ধরে হিসাব করা হয়। অথচ ঢাকা শহরে বাসে আসন খালি থাকে না। অনেক সময় যাত্রীদের দাঁড়িয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে যেতে দেখা যায়। এ ছাড়া বাসে নির্ধারিত আসনের চেয়ে ৮-১০টি বেশি আসন থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস দিলে তাদের লোকসান হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাসমালিকদের ধর্মঘটে যাওয়ার হুমকি অযৌক্তিক। পরিবহন খাতে এ রকম অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে চাইবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তৃতীয় পক্ষ বলতে আপনি কাদের বোঝাচ্ছেন?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: তৃতীয় পক্ষ বলতে আমি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে বোঝাচ্ছি। মাঠে রাজনীতি অনুপস্থিত থাকায় তারা ফায়দা নিতে চাইবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের কথা আছে। সরকারের উচিত সড়ক আইন কার্যকর করে নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা। তারা যদি মালিকদের অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটে, তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনের বিরুদ্ধে তো মালিক ও শ্রমিক এককাট্টা। তাঁরা কিছুতেই আইন বাস্তবায়ন করতে দিতে চাইছেন না।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে সরকারের আইন ও পরিকল্পনা হোঁচট খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার তো দুর্বল নয়। তারা চাইলে আইন বাস্তবায়নের বাধাগুলো দূর করতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা সড়ক আইন সংশোধনের জন্য কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: তাঁরা যৌক্তিক কোনো দাবি আনলে সেটি বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অযৌক্তিক দাবি মানার জন্য সরকারকে চাপ দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। আমরা সরকারের কাছে মালিকদের অযৌক্তিক দাবি না মানার জন্য অনুরোধ জানাই। সরকারকে জনস্বার্থ আমলে নিতে হবে। মালিকদের প্রেসক্রিপশন নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যাত্রী কল্যাণ সমিতি যাত্রীদের কতটা কল্যাণ করেছে?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: ২০০০ সালে চট্টগ্রাম থাকাকালেই আমরা যাত্রী কল্যাণ সমিতির কাজ শুরু করি। গণপরিবহনের যাত্রী হিসেবে দেখেছি যাত্রীরা নিয়মিত হয়রানি ও দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। অপমানিত হচ্ছেন। অনেক স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ২০০৬ সাল থেকে ঢাকায় এর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১৭টি জেলা শহরে ও কিছু উপজেলায় সমিতির শাখা আছে। মূলত যাত্রীদের সমস্যা ও ন্যায্য দাবির কথা সরকারের কাছে তুলে ধরতেই এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। গণপরিবহনে যাঁরা চড়েন, তাঁরা আর্থিকভাবে দুর্বল হতে পারেন, কিন্তু সম্মানের সঙ্গে চলাচল করার অধিকার তাঁদের আছে। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মালিকদের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত চলতে পারে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: গণপরিবহনসংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে কি আপনারা যাত্রীদের পক্ষে বক্তব্য দিতে পারছেন?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও কমিটিতে দর-কষাকষি করার সুযোগ পেয়েছি। ২০১২ সালে যখন পরিবহনমালিকেরা অবৈধ পন্থায় বাসভাড়া বাড়ালেন, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু ২০১৫ সালের পর আর আমাদের ডাকা হয় না। যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিতেও জনগণের কোনো প্রতিনিধি নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নিরাপদ সড়কের দাবিতে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনও আন্দোলন করছেন। আপনারাও যাত্রীদের কল্যাণে কাজ করছেন। দুই সংগঠনের মধ্যে কাজের কোনো সমন্বয় আছে কি?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: আমি মনে করি, ইলিয়াস কাঞ্চন জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যেমন অসামান্য অবদান রেখেছেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও। আমরা তাঁকে অনুসরণ করি। কিছু কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের মূল লক্ষ্য এক।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সম্প্রতি এক দিনের ব্যবধানে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়ির চাপায় দুজন মারা গেলেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গড়ি চালাচ্ছিলেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আর উত্তরের গাড়িটি চালাচ্ছিলেন একজন বহিরাগত চালক। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলে দুই সিটি করপোরেশন প্রভাবশালী সদস্য। সিটি করপোরেশন নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত। দুই সিটি করপোরেশন যা করেছে, তা চরম দায়িত্বহীনতা। কোনো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান যদি দায়িত্বহীন আচরণ করে, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? যাদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার কারণে দুটি প্রাণ ঝরে গেল, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমরা যখন উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি, তখন দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে কেন তাদের অনুসরণ করব না? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন থাকবে দুই ভিকটিম পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। ক্ষতিপূরণে আমাদের অভিজ্ঞতা হলো উচ্চ আদালতের রায়ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো মানছে না। সংবাদ-এর সাবেক বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রী আজও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাননি। আরও অনেকে পাননি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনারা যাত্রীদের কল্যাণে কাজ করছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেশ কিছু নারী পরিবহনকর্মীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। এসব পরিবহন সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে সড়কে নামে। সে ক্ষেত্রে পরিবহনমালিকদেরও কি দায় নেই?

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: অবশ্যই দায় আছে। বাংলাদেশে যাঁরা গণপরিবহনের মালিক, তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী। গণপরিবহনের কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মালিকদের অনুরোধ করব, তাঁরা যেন নিয়োগের আগে কর্মীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন, আর নিয়োগের পর নিয়মিত মনিটর করেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: গণপরিবহন খাতের সার্বিক পরিস্থিতি কী? এই খাতে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: কতিপয় সুযোগসন্ধানী শ্রমিকনেতা এই খাতকে জিম্মি করে রেখেছেন। ঘন ঘন বাস দুর্ঘটনার কারণ ইজারা প্রথা। মালিক শ্রমিকদের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেন, এত টাকা দিতে হবে। শ্রমিকেরা সেই টাকা তুলতে বেপরোয়া বাস চালান, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। সব মিলিয়ে গণপরিবহনে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। শ্রমিক কল্যাণের নামে সড়ক পরিবহন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়; কিন্তু শ্রমিকেরা কিছু পান না। প্রভাবশালী মালিকেরা রুট নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে দুর্বল মালিকেরাও বঞ্চিত হন। এই অবস্থার অবসান না ঘটলে পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।