সজাগ থাকলে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসবে না

ডা. মোজাহেরুল হক। লন্ডন হসপিটাল মেডিকেল কলেজ থেকে লিগ্যাল মেডিসিন ও ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক পরিচালক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা। বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন সাউথ–ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল এডুকেশন থেকে। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন :

করোনায় দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এক অঙ্কে এবং সংক্রমণের হার ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটা কি স্বস্তিদায়ক বলে মনে করেন?

মোজাহেরুল হক: স্বস্তিদায়ক অবশ্যই। আমাদের এটা ধরে রাখতে হবে। সংক্রমণ আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। সংক্রমণের হার ১ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। ১ শতাংশের নিচে নামলেই বলা যাবে বাংলাদেশ মোটামুটি করোনামুক্ত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, করোনা বৈশ্বিক মহামারি। অন্যান্য দেশ থেকে করোনা চলে না গেলে আমরা ঝুঁকিমুক্ত আছি বলা যাবে না। যত দিন বিশ্বে করোনা আছে, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বাইরে থেকে করোনাভাইরাস যাতে না ঢুকতে পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তদারকি বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, মসজিদের ইমামদেরও সংশ্লিষ্ট করতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। গা ছাড়া ভাব দেখানো যাবে না।

প্রশ্ন :

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দাবি করছেন, করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় তাঁরা সফল। আসলে কি তাঁরা সফল? সাফল্য-ব্যর্থতার পরিমাপ কীভাবে করবেন?

মোজাহেরুল হক: প্রথম কথা হলো, করোনা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা সরকারের ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু সরকার সেভাবে আমলে নেয়নি। একটিমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করেছে। এটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। প্রথম দিকে আমরা করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ল্যাবও স্থাপন করতে পারিনি। কত দিনে, কীভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করব, সে বিষয়ে আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা ছিল না, থাকা উচিত ছিল। রোগী শনাক্তকরণে আমরা বিলম্ব করেছি। সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টাও তেমন ছিল না। সরকার পরে অবশ্য পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়িয়েছে। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন–সুবিধা বাড়িয়েছে। এককথায় বলতে হয়, আমরা করোনার পেছনে দৌড়িয়েছি। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার মূল কথা হলো সংক্রমণ প্রতিরোধ ও আগাম প্রস্তুতি। আমাদের উচিত ছিল সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক রোগীকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা করা। তাঁর সংস্পর্শে কারা এসেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা। প্রথমে ঢাকা শহরের যে এলাকায় রোগী শনাক্ত হলেন, মারা গেলেন; সে সময়ে যদি শনাক্ত করা যেত তাঁদের সংস্পর্শে কারা এসেছেন, তাঁদের কোয়ারেন্টিনে রেখে চিকিৎসা করতে পারলে সামাজিক সংক্রমণ ঘটত না। সেই কাজটি সঠিকভাবে করিনি বলেই করোনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল; বিশেষ করে ডেলটা ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

প্রশ্ন :

আপনি সংক্রমণের কথা বলবেন, কিন্তু আমরা কি রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা দিতে পেরেছি? পত্রিকায় পড়েছি, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে ফিরে গেছেন?

মোজাহেরুল হক: আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হলো, সবকিছু বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। আমরা ইফেক্টিভ রেফারেন্স সিস্টেম চালু করতে পারিনি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সক্ষমতা কম। সেটি বাড়াতে পারলে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হতো না। কেবল করোনা নয়, নতুন নতুন রোগে তো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলা কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম সক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো রোগীর চিকিৎসা সেখানে সম্ভব না হলে তাঁরা জেলা সদরে পাঠাবেন, জেলা সদরেও সম্ভব না হলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কিংবা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাবেন। এ জন্য ইফেক্টিভ রেফারেন্স সিস্টেম চালু করতে হবে। নিচের স্তরের রেফারেন্স ছাড়া কোনো রোগী ওপরে আসবেন না। এটি করতে পারলে চিকিৎসাসেবায় শৃঙ্খলা আসবে। সবাই বড় বড় শহরে ভিড় করবেন না।

প্রশ্ন :

করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা দেখছেন কি?

মোজাহেরুল হক: আমরা যদি সতর্ক থাকি, তাহলে তৃতীয় ঢেউ আসবে না। সর্বাত্মক প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয়ের প্রতি জোর দিতে হবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া; যাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। তবে এটি কিন্তু সব সময় এক অবস্থায় থাকবে না, সময়ের ব্যবধানে প্রতিরোধক্ষমতা কমবে। সে ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ দেওয়ারও প্রয়োজন হবে। তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মানানোর ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখাই।

প্রশ্ন :

আপনি করোনা সংক্রমণ রোধে টিকার ওপর জোর দিয়েছেন। টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কোন অবস্থায় আছি?

মোজাহেরুল হক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে পারলেই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। যত দ্রুত সম্ভব ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমার হিসাবে ২৪ কোটি টিকা লাগবে। আর বুস্টার ডোজ দিলে আরও ১২ কোটি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। প্রথমত স্বাস্থ্যসেবায় যাঁরা নিয়োজিত, অর্থাৎ রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের সবার আগে টিকা দিতে হবে। আর বয়স্ক ও রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণটিকা কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। টিকার ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ, সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রেও কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। নীতিনির্ধারকদের নির্দিষ্ট করে বলতে হবে, কত দিনে প্রথম ডোজ ও কত দিনে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শেষ হবে। আমি মনে করি, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম ডোজ এবং জানুয়ারির মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ শেষ করা উচিত।

প্রশ্ন :

১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ শিশুদের টিকা দেওয়া নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।

মোজাহেরুল হক: এ বিষয়ে বিশ্বে গবেষণা চলছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তা পর্যালোচনা করছে। এখনো তারা শিশুদের টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেয়নি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে শিশুদের অর্ধডোজ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।

প্রশ্ন :

করোনা মহামারি থেকে আমরা কী শিখলাম?

মোজাহেরুল হক: আমরা এটাই শিখলাম, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। সেই প্রস্তুতি হলো কীভাবে ও কত দিনে আমরা সেই দুর্যোগ মোকাবিলা করব, তার কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়া। করোনা দুর্যোগ মোকাবিলার দুটো দিক ছিল—এক. সংক্রমণ প্রতিরোধ; দুই. সংক্রমিত ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। প্রথম দিকে আমরা রোগী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে পরীক্ষার ওপরই জোর দিইনি। পরীক্ষার আরটি–পিসিআর মেশিন, অবকাঠামো—খুবই সীমিত ছিল। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাসেবাও ছিল অপ্রতুল। আমাদের প্রয়োজনীয় আইসিইউ, অক্সিজেন মাস্ক, ভেন্টিলেটর—কিছুই ছিল না। উপজেলা, এমনকি জেলা স্তর পর্যন্তও এর সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারিনি। এই অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিই, তাহলে সব স্তরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দক্ষ লোকবল নিশ্চিত করতে হবে। সর্বত্র ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার ঘাটতি লক্ষ করছি। একটি উদাহরণ দিই। গত অর্থবছরগুলোতে মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ ছিল, তা-ও তারা খরচ করতে পারেনি। বরাদ্দ ফেরত গেছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার মান এমন পর্যায়ে নিতে হবে, যাতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না হয়; মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশে যেতে না হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান না, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও যান না। এমনকি নেপালের প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দেশে চিকিৎসা করান। তাহলে আমাদের মন্ত্রীরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন?

প্রশ্ন :

অনেকেই বলছেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ খুব কম। বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কি না।

মোজাহেরুল হক: উন্নত দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বরাদ্দ সবচেয়ে কম। তবে বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, সেই বরাদ্দ খরচ করার সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন গাড়িচালকের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কেবল একজন গাড়িচালক নয়, স্বাস্থ্য বিভাগের যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আত্মসাতের অভিযোগ আছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মোজাহেরুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।