সরকার এখনো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে আছে

বিনায়ক সেন।
বিনায়ক সেন।
>

চলমান কোভিড মহামারি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে; এখন এবং সামনের দিনগুলোতে আরও কী কী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে; মহামারির মতো ব্যাপক স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়কালে দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে—এসব এবং আরও নানা আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রথম আলো: আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কি খুব কার্যকর হচ্ছে বলে আপনার মনে হচ্ছে?

বিনায়ক সেন: ১৪ শতকে প্রধানত ইউরোপে যে প্লেগ মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, তখন রোগটির বিস্তার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার লোকজনকে ঘরে অবরুদ্ধ রাখার কৌশল নিয়েছিল। কোয়ারেন্টিন শব্দটার ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকেই। মিশেল ফুকো লোকজনকে কোয়ারেন্টিন করার এই ব্যবস্থাটাকে বলেছেন ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার। প্লেগের সময় ওটা বেশ কাজে দিয়েছিল। কিন্তু ১৮৩০ সালের দিকে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে যখন কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল, তখন দেখা গেল ডিসিপ্লিনারি মডেলটা আর সেভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না। প্লেগের ক্ষেত্রে যেটা করা যাচ্ছিল, কলেরার ক্ষেত্রে সেটা দিয়ে মহামারি রোধ করা যাচ্ছে না। কলেরা মহামারি রোধের জন্য দরকার ছিল বাসস্থানের পরিবেশের উন্নয়ন। শ্রমিকদের বসতিগুলোর অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে সেগুলো ছিল কলেরা মহামারির সূতিকাগার। সেই সময়ে রাষ্ট্রের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয় যে ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার দিয়ে কাজ হবে না; রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে। এর মানে হচ্ছে, মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষার জন্য তাদের জীবনযাপনের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। মিশেল ফুকো এটাকে বলেছেন বায়োপাওয়ার। রাষ্ট্রের ওপর সেই চাপের একটা প্রায় তাৎক্ষণিক ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই, ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে প্রথমবারের মতো লন্ডন শহরে আন্ডারগ্রাউন্ড পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো। কারণ, পানিবাহিত রোগ হিসেবে কলেরা যেহেতু পয়োনিষ্কাশন থেকেই বেশি ছড়াচ্ছিল, সেহেতু সেটাকে স্বাস্থ্যসম্মত করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। রাষ্ট্র পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার ওপর বিনিয়োগ করল।

প্রথম আলো: আমাদের দেশে কোন মডেলটা চলছে?

বিনায়ক সেন: আমরা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার মডেলটাতেই থেকে গেছি। আমরা এখনো কোয়ারেন্টিন করা কিংবা সেলফ কোয়ারেন্টিন ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারিনি। ‘আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে’ বলা ছাড়া, অথবা যেসব এলাকা অতিসংক্রমিত, তাদের লকডাউন করা ছাড়া অন্য মডেলে পুরোপুরি যেতে পারিনি। আমরা বায়োপাওয়ারের মডেলে গেছি আংশিকভাবে; যেমন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের টিকা দিয়েছি। কিন্তু এর বেশি নয়।

প্রথম আলো: আরও কী কী করা প্রয়োজন ছিল?

বিনায়ক সেন: আমাদের একটা শক্তিশালী সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এমন একটা ব্যবস্থা, যা দেশের সব নাগরিককে সব ধরনের সংক্রামক ব্যাধির মহামারি থেকে রক্ষা করবে।

প্রথম আলো: এ রকম কথা তো অনেকেই বলছেন। কিন্তু সে রকম একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আমাদের কী করতে হবে?

বিনায়ক সেন: প্রথমত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখন আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল। সরকার নিজেই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লেখা রয়েছে যে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশ হতে হবে। হয়নি এবং এ বছরেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব, আমাদের বরাদ্দ কত কম। যেমন শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২ দশমিক ৫৫, থাইল্যান্ডে প্রায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বা তারও নিচে। ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৮ ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ—এগুলো মন্দ উদাহরণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা কোভিড মোকাবিলায় ভালো করেছে, যেমন শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম, তাদের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ আমাদের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি। আর উন্নত দেশগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য: তাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৬ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ না করেও, ২ থেকে ৩ শতাংশ বরাদ্দ করেও একটা সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটা মডেল গড়ে তুলতে পারি, যেমনটা শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, এমনকি ভারতের কেরালা রাজ্যেও আছে।

প্রথম আলো: তাদের মডেলটা কী? আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাও কিন্তু কাগজ-কলমে সর্বজনীন; আইনত এটা থেকে কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করা যাবে না। শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম বা কেরালার মডেলটা কী?

বিনায়ক সেন: সেটা হলো একটা কার্যকর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকাঠামো আছে, কিন্তু সেটা গড়ে তোলা হয়েছে মূলত টিকাদান বা রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। কিউরেটিভ হেলথকেয়ার বা চিকিৎসামূলক স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। গ্রামাঞ্চলে কিছুটা আছে, কিন্তু নগরাঞ্চলে নেই বললেই চলে। এখন, এই কোভিড মহামারির সময়ে, যে এলাকাগুলোকে অতিসংক্রমিত রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া—এসব এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসামূলক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো নেই। সেটা গড়ে তোলা উচিত।

প্রথম আলো: কাঠামোটা কেমন হবে?

বিনায়ক সেন: সেটা হবে এ রকম যে ধরুন, ঢাকার উত্তরা এলাকায় ৩ নম্বর ও ৫ নম্বর সেক্টর মিলিয়ে থাকবে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক, ৭ নম্বর ও ৯ নম্বর সেক্টর মিলিয়ে একটা স্বাস্থ্য ক্লিনিক, রাস্তার ওপাশে ৪ নম্বর ও ৬ নম্বর সেক্টর মিলিয়ে আরেকটা স্বাস্থ্য ক্লিনিক। এমনিভাবে শহরের নিম্নবিত্ত এলাকাগুলোতেও ওয়ার্ড ভাগ করে করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক গড়ে তুলতে হবে। এগুলো হবে এমন একেকটা চিকিৎসাকেন্দ্র, যেখানে যেকোনো মানুষ যেকোনো রোগের উপসর্গ নিয়ে হাজির হতে পারবে এবং প্রাথমিক চিকিৎসা পাবে। আজ আমরা সংক্রমণের যে হিসাবটা দিচ্ছি, তা দেশের যথাযথ স্বাস্থ্যচিত্র তুলে ধরে না। কারণ, এই সংক্রমণের হিসাবের ভিত্তি হচ্ছে পিসিআর টেস্টিং। এখন সরকারিভাবে যে নির্দিষ্টসংখ্যক পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেখানে জায়গা করে নেওয়া কঠিন এবং জটিল। এর বাইরে একটা পিসিআর টেস্ট করাতে লাগে চার হাজার টাকা। একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন আট হাজার টাকা; কেন তিনি তাঁর মাসের বেতনের অর্ধেক টাকা দিয়ে একটা পিসিআর টেস্ট করাবেন? এ ধরনের কর্মজীবীদের জন্য কর্মস্থলভিত্তিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেকের স্বাস্থ্য কার্ড থাকবে, সেটার ভিত্তিতে এলাকার স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থেকে প্রত্যেকে চিকিৎসাসেবা পাবেন। প্রত্যেকের বছরে একবার প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষ করে শ্রমিকদের জন্য একটা মাইক্রো হেলথ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা করা দরকার। সরকারি কর্মকর্তারা যেমন একধরনের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় থাকেন, তেমনি একটা ব্যবস্থা তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকদের জন্য করা যেতে পারে। ২০১৫ সালে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাঁরা মাসিক তিন-চার শ টাকা প্রিমিয়াম দিতে প্রস্তুত। সেটার সঙ্গে ধরা যাক আরও এক হাজার টাকা মাসিক প্রিমিয়াম যুক্ত করতে হবে। এই ব্যয়টা সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিল্পমালিক যৌথভাবে বহন করতে পারে। কিন্তু সেটা কে বহন করবে, সেটা পরের কথা, কথা হচ্ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমা থাকতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন, পিসিআর টেস্টের ভিত্তিতে সংক্রমণের যে হিসাব আমরা পাচ্ছি, সেটা মহামারির প্রকৃত চিত্র নয়। প্রকৃত চিত্র পাওয়ার উপায় তাহলে কী?

বিনায়ক সেন: যারা পিসিআর টেস্ট করার খরচ বহন করতে পারছে, তারা মধ্যবিত্ত ও তার ওপরের স্তরের লোকজন। আমরা গরিবদের মধ্যে সংক্রমণের কোনো চিত্রই পাচ্ছি না; কারণ, পিসিআর টেস্ট করানোর আর্থিক সামর্থ্য অথবা সরকারি টেস্টের একসেস তাদের নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে হয়তো অনেক সংক্রমিত ব্যক্তি আছে, যাদের উপসর্গ প্রকাশ পায়নি। এ রকম উপসর্গহীন অনেক ভাইরাস বহনকারী মানুষ হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের অজান্তে অন্যদেরও সংক্রমিত করছে। তাদের কিন্তু পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের ক্ষেত্রে র‍্যাপিড টেস্টিং কিটের মতো অপেক্ষাকৃত সুলভ পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করা জরুরি।

প্রথম আলো: সংক্রমণ আরও বেড়ে চলেছে, কিন্তু এর মধ্যে সব খুলে দেওয়া হয়েছে। এটা আপনি কীভাবে দেখছেন?

বিনায়ক সেন: আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, কোভিডের অতিসংক্রমণের জন্য যে এলাকাগুলোকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকেও রেড জোন। দিল্লি ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্র, অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, সে দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হচ্ছে মুম্বাই। আর আমাদের রাজনৈতিক কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র—দুটোই ঢাকা। অর্থনৈতিক রেড জোনগুলোকে তো লকডাউন করা যাবে না, খুলতে হবে; তবে খোলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

প্রথম আলো: ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা’ কথাটা বোধ হয় অতিব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। এ কথায় লোকে আর গা করে বলে মনে হয় না।

বিনায়ক সেন: সরকারের আইইডিসিআর দিনরাত বলছে বাসার ভেতরে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে, যেনবা দায়দায়িত্ব সব আমার। এখানে বায়োপাওয়ার তার দায়দায়িত্ব পালন করছে না। বায়োপাওয়ারের দায়িত্ব শুধু ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার বা নিজের সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেকে নিতে উদ্বুদ্ধ করা নয়। দায়িত্বটা হলো মানুষের বাসস্থানের পরিবেশ উন্নত করা, মানুষকে একটা স্বাস্থ্যসেবা-জালের মধ্যে নিয়ে আসা। সেই কাজটা আমাদের দেশে করা হয়নি। এ জন্য আমাদের স্বাস্থ্য খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে। যখন আপনি প্রতিটি এলাকায় বাসস্থানভিত্তিক ও কর্মস্থলভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা ভাববেন, তখন আপনাকে নতুন বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে। আজকে যে বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ নেই; কেননা, তারা বরাদ্দের অর্থ খরচ করতে পারে না—কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। স্বাস্থ্য খাতে ইতিপূর্বে বরাদ্দের সব অর্থ খরচ করা যায়নি; কারণ, আমরা মধ্যবিত্তরা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা ব্যবহার করি না।

প্রথম আলো: মধ্যবিত্তরা কেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায় না?

বিনায়ক সেন: কারণ, তারা আস্থা পায় না; আস্থা না পাওয়ার কারণ সরকারি চিকিৎসাসেবার মান উন্নত নয়। এর জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হবে; জনবল নিয়োগ করতে হবে, নতুন চিকিৎসক নিতে হবে, নার্স নিতে হবে, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিতে হবে। তাই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর পক্ষে যে যুক্তি শোনা যায়, সেটার সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, আগামী অর্থবছরের বাজেটেই স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির এক থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করতে হবে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে সেটাকে আড়াই থেকে তিন শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে। তাহলে আমরা অন্তত শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের পর্যায়ের বরাদ্দে যাব।

প্রথম আলো: কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিশেষত ক্রয়ের ক্ষেত্রে পুকুরচুরি হয়; আমাকে এক চিকিৎসক বললেন, ৮-১০ লাখ টাকা দামের ভেন্টিলেটর কিনতে খরচ দেখানো হয় ৩০-৩২ লাখ টাকা। হাসপাতালের পর্দা ইত্যাদি সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমন ব্যাপক দুর্নীতি চলতে থাকলে তো বরাদ্দ বাড়ালে তার সুফল জনগণ পাবে না; স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজেরাই আরও বেশি লাভবান হবে।

বিনায়ক সেন: শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, বরাদ্দ অর্থের সদ্ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি রোধে শক্তিশালী ও স্থায়ী রেগুলেটরি কমিশনের বিকল্প নেই; এর লক্ষ্য হবে সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত বাজারমূল্য অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। এটা হলে স্বাস্থ্য খাতে ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে এ রকম নয়ছয় বন্ধ হয়ে যাবে। কোভিড-সংক্রান্ত যেসব তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিচ্ছে, যেমন বেডের সংখ্যা, আইসিইউর সংখ্যা—এসব তথ্য সঠিক নয়। শনাক্ত সংক্রমণের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, তা-ও সঠিক নয়। আমি মনে করি, তাদের দেওয়া মৃত্যুর হারও সঠিক নয়। মে মাসের প্রথম ভাগ থেকে জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত দেশে মোট সংক্রমণের সংখ্যা আড়াই গুণ বেড়ে গেল, অথচ সামগ্রিক মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৫ থেকে ১ দশমিক ৪ শতাংশেই আটকে থাকল কোন ম্যাজিকে? আর সারা বিশ্ব যখন জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতি, তখনো আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় আটকে আছে জিডিপির ডিসকোর্সের মধ্যে। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি সবাই চাই, কিন্তু উন্নয়নের লক্ষ্য জিডিপি নয়, জিডিপির লক্ষ্য মানুষকে উন্নত স্বাস্থ্য দেওয়া। মহামারির বছরেও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে গুণগতভাবে কোনো পরিবর্তন এল না।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের দুটো প্রধান কর্তব্যের একটা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মাধ্যমে নাগরিকদের সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়া, আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক দায়িত্ব হলো নাগরিককে মৃত্যু থেকে বাঁচানো। প্রথমটি হচ্ছে ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার: দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বায়োপাওয়ার, রাষ্ট্র নাগরিককে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরিয়ে আনবে; রাষ্ট্র তাকে স্বাস্থ্য পরিচর্যা দেবে। এটা কোনো অবাস্তব দাবি নয়। এর পক্ষে আমরা কেন সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলব না?

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

বিনায়ক সেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।