সাংবাদিকতায় বাধা সৃষ্টিকারী আইন থাকা উচিত নয়

স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সোচ্চার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক–এর সঙ্গে।

নাসিমুন আরা হক

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে রোজিনা ইসলামকে নির্যাতনের পর মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলো। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমের প্রতি ক্ষমতাবান ও আমলাদের বৈরী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কি না?

নাসিমুন আরা হক: অবস্থা দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আদর্শিক অবস্থা হচ্ছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশাসনের মানুষজনের সুসম্পর্ক থাকবে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সাংবাদিকেরা তথ্য সংগ্রহ করবেন। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে সচিবালয়ে যে ঘটনাটা ঘটল, তা অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক। সচিবালয় তো কাউকে আটকে রাখার জায়গা নয়, তা তিনি সাংবাদিক হোন আর সাধারণ মানুষ হোন। রোজিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিও মানহানিকর। কৌশল করেই সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। সচিবালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা সেখানেই সমাধান হতে পারত। কিন্তু কিছু কর্মকর্তার বৈরী বা কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য এটা হয়নি।

প্রশ্ন :

আপনি এই যে বৈরী আচরণের কথা বললেন, এ কথা সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সম্প্রতি বলেছেন। তাঁদের কথা, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকারকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটি কি এমন?

নাসিমুন আরা হক: সচিবালয়ের ঘটনায় এমনটি মনে হচ্ছে। এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে। রোজিনা ইসলামের বিভিন্ন প্রতিবেদনের কারণে তাঁর ওপর হয়তো ক্ষোভ ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। তাঁরা রোজিনাকে হয়রানির জন্যই এসব ঘটিয়েছেন। এটি খুবই নিন্দনীয়। তাঁরা রোজিনার সঙ্গে যে আচরণ করলেন, সেটি এক অর্থে মাস্তানি। এর মাধ্যমে দেশের ক্ষতি হলো। সরকার বলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে। রোজিনাকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তার মাধ্যমে সরকারের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হলো। দেশের বাইরেও ভাবমূর্তি নষ্ট হলো।

প্রশ্ন :

নানা ধরনের হয়রানি বা নিগ্রহের ঘটনা তো রয়েছেই, এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের প্রয়োগও দেখা গেল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করেন কি?

নাসিমুন আরা হক: যে ঘটনা সম্প্রতি সচিবালয়ে ঘটানো হলো, এর উদ্দেশ্য ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করা। আর পুরো ঘটনাই ঘটানো হয়েছে দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায়। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট একটি ঔপনিবেশিক আইন। এটি সরকারি কর্মচারীদের জন্য করা হয়েছিল। সাংবাদিকের ওপর এর প্রয়োগ একটা বিরল ঘটনা। সরকার তথ্য অধিকার আইন করেছে। এর সঙ্গে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংঘর্ষিক।

প্রশ্ন :

নানা মহলের আপত্তির পরও সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করেনি। এ আইনের কারণে ভীতির আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এটি গণমাধ্যমকে চাপে রাখার কৌশল কি না?

নাসিমুন আরা হক: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন হলো, তখন বিভিন্ন পেশার মানুষের মতো সাংবাদিকেরাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। বাস্তবে আমরা দেখছি, দু-একটি ঘটনা বাদ দিয়ে এর প্রয়োগ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বেশি হচ্ছে। এটা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকির সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এসব নিবর্তনমূলক আইনের প্রয়োগ বা প্রয়োগের চেষ্টা কি সুশাসনের অভাবের চিত্রকে তুলে ধরে?

নাসিমুন আরা হক: সাংবাদিকেরা যদি মুক্তভাবে কাজ করতে পারেন, হয়রানি না থাকে, মতপ্রকাশের অধিকার থাকে, তবে আমরা বলব যে দেশে গণতন্ত্র আছে। শুধু নির্বাচন দিলেই তো গণতন্ত্র নিশ্চিত হয় না। মুক্তচিন্তার, মতপ্রকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সাংবাদিকতায় বাধা সৃষ্টি করে, এমন কোনো নিবর্তনমূলক আইন থাকা উচিত নয়। পাশাপাশি দাবি থাকবে, সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন চাই।