স্বাধীনতা নিরন্তর সাধনার বিষয়

মুক্তিযুদ্ধের আগে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রবর্তী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। তিনি পাকিস্তানের বিরূপ শাসনামলে বাংলা বর্ষবরণ ও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনসহ নানা কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা, মুক্তিযুদ্ধকালে ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সভাপতি এবং ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী ও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে কবি পিয়াস মজিদ তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন।

সন্‌জীদা খাতুন। ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ১৯৬০-এর দশকে বাংলা বর্ষবরণ, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ, ছায়ানটের কার্যক্রম—এসব সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে স্বাধিকার আর স্বাধীনতামুখী রাজনীতির যোগ কতটা ছিল?

সন্‌জীদা খাতুন: ছায়ানটের সব কার্যক্রম বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণমূলক ছিল নিঃসন্দেহে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার সাধনা তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতামুখী অভিযাত্রার সঙ্গে আমাদের বাস্তবিক যোগ ছিল না।

প্রশ্ন :

বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার কারণে আপনাকে শাস্তিমূলকভাবে রংপুরের একটি কলেজে বদলি করা হয়েছিল। মফস্বলে স্বাধীনতামুখী সাংস্কৃতিক ঝোঁকটা কেমন দেখেছেন?

সন্‌জীদা খাতুন: বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ‘অপরাধে’ আমাকে শাস্তিমূলকভাবে সুদূর রংপুরে বদলি করা হয়েছিল। সেখানকার কারমাইকেল কলেজে কিছু কিছু শিক্ষকের ভেতরে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেতনা জাজ্বল্য ছিল। ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে এসব চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল একটি ঘটনায়। একজন শিক্ষক ইংরেজিতে হাজিরা নিতেন। বারবার বাংলায় ক্রমিক নম্বর বলার অনুরোধ করার পরও তিনি কথা গ্রাহ্য করেননি বলে তাঁর ক্লাসে সাড়া না দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাঁকে ক্লাসঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। তা ছাড়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শোনা যেত ছাত্রদের মুখে। এসব স্বাধীনতার আগ্রহের পরিচয়, সন্দেহ কী!

প্রশ্ন :

এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আপনাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে বলেছিলেন। পরবর্তীকালে গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত হলো।

সন্‌জীদা খাতুন: পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ‘কার্জন হলে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের সামনে তিনি আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইবার জন্য অনুরোধ করে পাঠিয়েছিলেন। পাঁচ স্তবকের অত বড় গানখানি মুখস্থ ছিল না বলে গীতবিতান বইয়ের খোঁজ পড়েছিল সেদিন। ওই গানটির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণ এত প্রবল ছিল যে দেশ শত্রুমুক্ত হলে এটিকেই তিনি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দান করেছিলেন। আজ এ কথা উপলব্ধি করে পঞ্চাশের দশকে তাঁকে এ গান শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছিল মনে করে ধন্য মানি।

প্রশ্ন :

একাত্তরের ২৫ মার্চে কোথায় ছিলেন?

সন্‌জীদা খাতুন: ২৫ মার্চ ঢাকার রাস্তায় কোথাও কোথাও ব্যারিকেডের আয়োজন আর মানুষের জটলা দেখে ঘরে ফিরে সারারাত গোলাবর্ষণের ভয়াবহ শব্দ শুনেছিলাম। পরদিন সকাল দশটার পরে সাভারের জিরাবো এলাকার চেয়ারম্যান দেওয়ান মোহাম্মদ ইদ্রিস বাসায় এলেন। বললেন, আমাদের গাড়িটা পেলে ছেলেমেয়েদের সাভারের গ্রামে রেখে আসতে পারেন। আমি আমার ছেলেমেয়েদেরও তাঁর সঙ্গে গ্রামে নিয়ে যেতে বললাম। মেয়েদের বিপদ-আপদ বিষয়ে ১৩ বছর বয়সী বড় মেয়েকে বুঝিয়ে বলে ইদ্রিস কাকার সঙ্গে সাভারে পাঠিয়ে দিলাম সন্তানদের।

২৬ মার্চ বিকেলের দিকে আলী যাকেরের গাড়ি এল আমাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার জন্য। মিরপুর ব্রিজে ব্যারিকেড দেখে ঘুরপথে নদীর ধারে গাড়ি রেখে নদী পার হয়ে রিকশা নিয়ে ভেঙে ভেঙে পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যার মুখে ইদ্রিস কাকার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম। সেখানে সেকি ভিড়! কাকা গ্রামের একটা বাড়িতে বেড়া দেওয়া স্নানঘর তৈরি করিয়ে আমার পরিবারকে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুন

প্রশ্ন :

এরপর ভারতে চলে গেলেন। জড়িয়ে পড়লেন নতুন সব কর্মতৎপরতায়। তা নিয়ে বলুন।

সন্‌জীদা খাতুন: ইদ্রিস কাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ২৮ মার্চ ঢাকায় গানের ছাত্রী ইফফাত আরা দেওয়ানের বাবার বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখান থেকে কালো বোরকা পরে ভারতের উদ্দেশে পাড়ি জমাই। লায়লা হাসানও তাদের ছোট্ট মেয়ে সঙ্গীতাকে নিয়ে কালো বোরকা পরে আমার সঙ্গে রওনা হয়েছিল। সারা দিনে দুমুঠো মুড়ি আর চাঁপাকলা খেয়ে কখনো রিকশা, কখনো অটোরিকশা, কখনো নৌকা করে চলে চলে শেষ বিকেল নাগাদ সোনামুড়া সীমান্ত পার হয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান ধরলাম। আগরতলায় দুই রাত এক দিন কাটিয়ে কলকাতা যাওয়ার ট্রেন ধরলাম আমরা। বিনা টিকিটে ভ্রমণ! কলকাতায় আমার শিক্ষক প্রবোধচন্দ্র সেনের কন্যার বাসায় এক দিন আর অধ্যাপক বিনয়েন্দ্র মোহন চৌধুরীর বাসায় কদিন থেকে আত্মীয় ব্যারিস্টার জাস্টিস মাসুদের বাসায় আশ্রয় পাওয়া গেল। জাস্টিস মাসুদ, সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী প্রমুখের চেষ্টায় একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকার হিল্লে হলো। একাত্তরের জুনে শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তর সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনই হয়েছিল আমার ঠিকানা।

কলকাতা ছাড়ার আগে একটা বড় কাজে যুক্ত হয়ে ধন্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের গানের শিল্পীরা কলকাতা পৌঁছে জাস্টিস মাসুদের বাসায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আমি তঁাদের ঠিকানা লিখে রাখতাম। একদিন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন এ রকম একদল লেখক-সাংবাদিক এলেন আমার কাছে। তাঁরা একটি বাসা ভাড়া করে গানের শিল্পীদের সবাইকে এক জায়গায় রেখে অনুষ্ঠান করে টাকা তুলে তাঁদের চলার ব্যবস্থা করতে চান। আমি তাতে বাস্তব কিছু সমস্যার কথা তুলে একটা মহড়া করার জায়গা বের করতে বললাম।

এভাবে ১৪৪ লেনিন সরণি, ধর্মতলায় আমাদের মহড়া দেওয়ার আয়োজন হলো। এই মহড়া থেকে ‘রূপান্তরের গান’ গীতি-আলেখ্য তৈরি করে রবীন্দ্রসদনে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের দুরবস্থার কাহিনি জানতে পেরেছিল কলকাতাবাসী। ওয়াহিদুল হক, হাসান ইমামরা আমাদের শিল্পী দলের সঙ্গে খুবই যুক্ত ছিলেন। ওয়াহিদুল আর হাসান ইমাম আবার লিবারেশন কাউন্সিলের সঙ্গেও ছিলেন। রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠানের পর দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে এত দিন আমাদের সহায়তা করছিলেন। এবার লিবারেশন কাউন্সিলের কথামতো ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ গড়ে নিজেরা দল পরিচালনা করবেন। ওয়াহিদুল আর হাসান ইমাম উপস্থিত থেকে মাহমুদুর রহমান বেণুকে সাধারণ সম্পাদক আর আমাকে সভাপতি করে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা গঠন করে দিলেন।

ওই শিল্পী সংস্থা দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ‘রূপান্তরের গান’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি উপস্থাপন করেছিলেন অনুষ্ঠানস্থলে। কলকাতা আর তার আশপাশে এই শিল্পীরা রূপান্তরের গান শুনিয়ে সবাইকে বাংলাদেশের সংগ্রামের কথা অবহিত করতেন। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থীদের মনোবল চাঙা করার জন্য ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে তাদের রূপান্তরের গান শোনানো হতো।

প্রশ্ন :

মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, রূপান্তরের গান—একাত্তরের কলকাতায় এসবের নেতৃত্বে ছিলেন আপনি। এসব কর্মকাণ্ডের প্রভাব কেমন পড়ল?

সন্‌জীদা খাতুন: মুক্তিযুদ্ধে এসব কর্মযজ্ঞের ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংগ্রামের বিষয়ে যেমন সহানুভূতিশীল হয়েছে, তেমনি শরণার্থী আর মুক্তিযোদ্ধারাও মানসিকভাবে বলিষ্ঠ হয়েছে।

প্রশ্ন :

একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এবং রবীন্দ্রসংগীত প্রসারের পথিকৃৎ হিসেবে আপনার কাছে প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথের গান মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল?

সন্‌জীদা খাতুন: একাত্তর সালের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, কলকাতা, তার আশপাশে আর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আমরা কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি। আমাদের গানের বাণী আর সুর মানুষকে জানিয়েছে বাংলা আর রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের ভালোবাসা পাকিস্তানি শত্রুদের নির্যাতনের মুখে পড়েছে। রূপান্তরের গানে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘আমার সোনার বাংলা’ এসব গান বাংলাদেশের জন্য আমাদের আবেগকে শ্রোতাদের কাছে অবারিত করেছে। বহুকাল আগে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান ‘ঢাকো রে মুখ, চন্দ্রমা’ বা ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহিয়ে’ কিংবা ‘সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে’ গানগুলো রূপান্তরের গানে বিন্যাস করে আমাদের লজ্জাকে, বেদনাকে শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেছি। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে তা অনুরণিত হয়েছিল। এই তিনখানি গানের একখানি খানিকটা উদ্ধৃত করলেই তার প্রভাব অনুভব করা যাবে। ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহিয়ে/ নগরে প্রান্তরে বনে বনে। অশ্রু ঝরে দু নয়নে,/ পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।/ জ্বলিয়া উঠে অযুত প্রাণ, এক সাথে মিলি এক গান গায়— / নয়নে অনল ভায়—শূন্য কাঁপে অভ্রভেদী বজ্রনির্ঘোষে!’

প্রশ্ন :

মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর হতে চলল। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন কতটা পূরণ হলো?

সন্‌জীদা খাতুন: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে যে স্বপ্ন মনে বাসা বেঁধেছিল, তা সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি আমাদের ভেতরের শত্রুর ষড়যন্ত্রে। কোনো একটা যুদ্ধে জয় পেলেই বাস্তবিক মুক্তি ঘটে যায় না। মুক্তি বা স্বাধীনতা নিরন্তর সাধনার বিষয়। স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য সর্বদা তৎপর থাকতে হবে। একটা বিজয় পেলেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। এসব কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকালে লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু আমরা সাবধান হইনি। স্বপ্নপূরণের জন্য আমরা কী করেছি, নিজেদের ভেবে দেখতে হবে। নিজেদের ত্রুটি সারানোর আয়োজন করতে হবে নিজেদেরই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সন্‌জীদা খাতুন: ধন্যবাদ।