বানান নিয়ে সাধারণ মানুষও এখন প্রশ্ন তোলে। আর বাংলা একাডেমি সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হিমশিম খায়। এর নমুনা ‘ইদ’, ‘গোরু’ এ দুটি বানান। শেষ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি জানাতে বাধ্য হয়, তাদের সর্বশেষ অভিধানে কিছু শব্দের বানানে ভুলত্রুটি ঘটে গেছে, পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে। কিন্তু অভিধানের নতুন সংস্করণে সেসব ‘ভুলত্রুটি’র অধিকাংশই অপরিবর্তিত আছে। ভাবতে অবাক লাগে, অজস্র শব্দের বানানে একাডেমির নিজেরই প্রবল দ্বিধা আছে। যেমন ‘কাহিনি’ না ‘কাহিনী’, ‘অলংকার’ না ‘অলঙ্কার’, ‘রং’ না ‘রঙ’, ‘শহিদ’ না ‘শহীদ’, ‘ছোটো’ না ‘ছোট’, ‘বড়ো’ না ‘বড়’, ‘উপলক্ষ্য’ না ‘উপলক্ষ’, ‘সম্মানি’ না ‘সম্মানী’, ‘পল্লি’ না ‘পল্লী’, ‘ঠেলা’ না ‘ঠ্যালা’, ‘ব্যবহারিক’ না ‘ব্যাবহারিক’...এই তালিকায় অন্তত পাঁচ শ শব্দ দেখানো যাবে।
বাংলা একাডেমি নিজেই সংকট তৈরি করে এখন পরিত্রাণের উপায় খুঁজছে। বানান জানা না-জানা ‘পণ্ডিত’দের একসঙ্গে করে সভাও করেছে। এসব শব্দ নিয়ে একাডেমি নতুন করে ভাবতে চাইছে, অথচ তার কোনো দরকার ছিল না। বিকল্প বানান তৈরি করে, মানুষের মধ্যে দুই বানানের দ্বিধা তৈরি করে এখন বাংলা একাডেমি সমাধান খোঁজ করছে।
১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল বানানে বিকল্প বর্জন করা। অর্থাৎ যেসব শব্দের একাধিক বানান প্রচলিত আছে, সেসব শব্দের একটি বানানকে মান্য হিসেবে ঠিক করা। বাংলা একাডেমি ১৯৯২ সালে যে উদ্যোগ নেয়, সেখানেও বিকল্প বর্জনের ব্যাপারটি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে স্বীকারও করে নেওয়া হয়, ‘বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার।’ এরপর বাংলা একাডেমি বানান নিয়ে আর যত কর্মকাণ্ড করেছে, তাতে বিকল্প আমদানির প্রবণতা দেখা গেছে। এখান থেকেই সংকটের সূচনা।
প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে, একটি ভাষার হাজার হাজার শব্দ কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে না। আরও সহজ করে বলা যায়, বানানের আসলে কোনো সূত্র নেই। বাংলা শব্দের আগে-পরে প্রত্যয়, উপসর্গ বা শব্দাংশ যোগ করার সময়ে কিছু ধ্বনিগত সূত্র অবশ্য ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু অভিধানের একেকটি শব্দের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেগুলো কোনো নিয়মের অধীন নয়। এমনকি, ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে যে পুস্তিকা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে, সেই নিয়মের অধীন গুটিকয় শব্দ মাত্র ফেলা যাবে। তাহলে বানান কি নিয়ম ছাড়াই চলে? হ্যাঁ, বানান চলে নিয়ম ছাড়াই। তাতে ভাষা-ব্যবহারকারীর কোনো সমস্যা হয় না। ‘সকাল’ বানানে কেন দন্ত্য-স, ‘শনি’ বানানে কেন দন্ত্য-ন, ‘জাহাজ’ বানানে কেন বর্গীয়-জ, এ নিয়ে কেউ ভাবে না। লেখার সময় আমরা আসলে প্রথাকেই অনুসরণ করতে থাকি। বরং নিয়ম বেঁধে দিয়ে সব বানান পরিবর্তন করে দিলে আমাদের পক্ষে সাবলীলভাবে লেখা সম্ভব হবে না, এমনকি পড়াও কঠিন হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, একই ধরনের সব শব্দকে একই নিয়মের অধীন ফেলাও সম্ভব নয়। যেমন অতৎসম শব্দে ঈ, ঊ, ণ, ষ বর্জনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ‘কৃষাণ’, ‘মানুষ’—এ রকম অজস্র শব্দ মূল বানানের চেহারা রক্ষা করে চলেছে।
বানান নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠাও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে আছে। ভাষার আর কোনো দিকে নজর নেই, শুধু বানান নিয়ে পড়ে আছি। একটা সাইনবোর্ডে কয়টা বানান ভুল, একটা লেখায় কয়টা বানান ঠিক নেই, এগুলো হিসাব করতে থাকি। শুধু হিসাব করা নয়, এগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করি। অথচ ভাষা নিয়ে ভাবার জায়গা আছে অনেক। আমরা ভালো গদ্য লিখতে পারি না, বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড কমে যাচ্ছে, সাধারণ নোটিশও এখন ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে—এসব নিয়ে কথা বলা দরকার।
বানান যখন মূল শব্দের চেহারা অনুসরণ করে, তখন তাকে বলা হয় ব্যুৎপত্তিমূলক বানান। যেমন ‘কর্ণ’ থেকে ‘কাণ’, ‘পূর্ব’ থেকে ‘পূব’, ‘যদ্যপি’ থেকে ‘যদি’ ইত্যাদি। উনিশ শতকের শুরুতে যখন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ব্যুৎপত্তিমূলক বানান প্রতিষ্ঠা পায়। এর কারণ, ওই সময় বাংলা ভাষার নিয়ন্ত্রণ ছিল সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে। প্রায় এক শ বছর ব্যুৎপত্তিমূলক বানান বাংলা শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বানানে উচ্চারণকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। তাঁর প্রভাবে দন্ত্য-ন, হ্রস্ব-ই, হ্রস্ব-উ, অনুস্বার—এসব বর্ণের প্রাধান্য পায় বাংলা শব্দে। মধ্যযুগের বাংলা বানানও ছিল উচ্চারণমূলক। আধুনিক যুগের সূচনালগ্নে যদি উচ্চারণমূলক বানানকে প্রাধান্য দেওয়া হতো, তাহলে অনেক শব্দের চেহারা পাল্টে যেত। তৎসম-অতৎসম শব্দের বানানের নিয়ম নিয়ে যে ভিন্নতা আছে, তা-ও বোধ করি কেটে যেত।
তবে একই সঙ্গে ব্যুৎপত্তিমূলক বানান আর উচ্চারণমূলক বানান থাকার কারণে সমস্যা তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে চোখ দিয়ে দেখা আর পড়ার অভ্যস্ততা তৈরি হয় বলে এতে কোনো সমস্যা হয় না। বানান যতক্ষণ প্রচলনকে মান্য করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তর্কও ওঠে না। অর্থাৎ প্রচলিত বানান, তা যদি বিকল্পহীন থাকে, সেখানে বাগড়া না দেওয়াই ভালো।
বানান নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠাও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে আছে। ভাষার আর কোনো দিকে নজর নেই, শুধু বানান নিয়ে পড়ে আছি। একটা সাইনবোর্ডে কয়টা বানান ভুল, একটা লেখায় কয়টা বানান ঠিক নেই, এগুলো হিসাব করতে থাকি। শুধু হিসাব করা নয়, এগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করি। অথচ ভাষা নিয়ে ভাবার জায়গা আছে অনেক। আমরা ভালো গদ্য লিখতে পারি না, বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড কমে যাচ্ছে, সাধারণ নোটিশও এখন ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে—এসব নিয়ে কথা বলা দরকার।
বানান নিয়ে স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা পালন করার কারণে বাংলা একাডেমিকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলা একাডেমির উচিত হবে বিকল্প তৈরি করা বানানগুলোর ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া। একই সঙ্গে নতুন করে বানানে বিকল্প তৈরি না করার নীতিও তাদের নিতে হবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক