কথা বলার স্বাধীনতা, তরুণ ভোটার ও রাষ্ট্রের গতিমুখ
স্রেফ কথা বলার অভিযোগে, তা–ও নিজের কথা নয়, একটি অনলাইন টক শোতে সঞ্চালক হওয়ার কারণে তাঁর প্রবাসী অতিথির বক্তব্য সরকারের কাছে আপত্তিকর মনে হওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দেড় বছর জেল খাটতে হলো কেবল জামিন পাওয়ার অপেক্ষাতেই। এই একটি ঘটনাই আরও অসংখ্য মানুষের দুর্ভোগের ভয়ংকর চিত্রটা আমাদের সামনে তুলে ধরে। খাদিজার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের এই দেড় বছর কে তাঁকে ফিরিয়ে দেবে? বাংলাদেশে এই বাস্তবতার সঙ্গে এক দশক ধরে নাগরিকদের ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়ার যোগসূত্র কি আছে? দেশের তরুণেরা কি এ নিয়ে ভাবেন?
সম্প্রতি জার্মান সংস্থা ডি ডব্লিউ একাডেমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্ক আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানের ভিডিওতে দেখা যায় তরুণেরা কথা বলছেন কথা বলার সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা নিয়ে। সেখানে কয়েকজনের নির্বাচিত কয়েকটা সংলাপ এখানে প্রাসঙ্গিক তাই তুলে ধরছি, সম্ভবত এগুলো দেশের তরুণসমাজের ভাবনাকেই অনেকখানি প্রতিফলিত করে।
ক. ‘আমরা যদি অন্যের বিপদে চুপ করে থাকি, তখন আমার যখন কোনো দরকার হবে, তখন আমার জন্য কথা বলার বা আমার পাশে দাঁড়ানোর লোকটা আমি খুঁজে পাব না।’
খ. ‘কথা বলা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। এটাই আসলে আমাদের মানুষ বানায়।’
গ. ‘ভয় না পেয়ে আমাদের কথা বলা উচিত। কেননা অধিকাংশ সময়ে আমরা যখন কথা বলি, আমাদের চুপ করতে বলা হয়, এটা তো হওয়া উচিত না।’
ঘ. ‘আমরা কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু কথা বলছি না।’
কথা বলার একটা বাধা যে সমাজে প্রবলভাবে তৈরি হয়েছে, সেটা তরুণদের এই সংলাপ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। কিন্তু সেই বাধাটা এত প্রবল কীভাবে হয়ে উঠল, সেই যোগসূত্রটাও ওই বিতর্কেই তরুণেরা স্পষ্ট করে বলছেন, আমাদের প্রজন্ম আসলে তো সুষ্ঠু কোনো ভোটই দেখেনি! ঠিকই তো, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কথা বলার স্বাধীনতা আর ভোটাধিকারের প্রশ্ন তো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কথা বলার, নিজের মতামত জানানোর স্বাধীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ তো ঘটে নির্বাচনে, ভোটের অধিকারে। যেখানে ভোটাধিকার নাই হয়ে যায়, সেখানে কি আর কথা বলার স্বাধীনতা থাকে? নিঃসন্দেহে তরুণদের মধ্যে যে এই বোঝাপড়া আছে, সেটা খুবই আশা সঞ্চারকারী দিক। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণের এই ঘটনা তরুণদের জন্য কী ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে? রাষ্ট্রের গতিমুখই বা এর মধ্য দিয়ে কোন দিকে যাচ্ছে?
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশে নতুনভাবে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হয়েছেন এমন তরুণের সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছেছে। এই সংখ্যা দেশের মোট ভোটারের প্রায় এক–চতুর্থাংশের বেশি। এর মধ্যে যাঁরা ২০১৪ সালের দশম এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটদানে উপযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ভোটদানেরই সুযোগ পাননি। সে বিবেচনায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য এ বিপুলসংখ্যক ভোটার এখনো প্রথম ভোটারই রয়ে গেছেন। এই তরুণেরা কি এবারের নির্বাচনেও ভোট দিতে পারবেন?
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও বিরোধী দল অংশ নিতে পারছে না, সে কারণে কার্যকর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। ফলে আবারও একটি একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। আবারও নাগরিকদের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথম ভোটার তরুণেরা বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন তাঁদের ভোটাধিকার থেকে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচন কিন্তু শুধু একটা ব্যালটে ভোট দেওয়ার অধিকার নয়; যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যুক্ততার প্রাথমিক ভিত্তি। এর অনেকগুলো দিক আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি ঠিকঠাক থাকলে নাগরিকদের জন্য সুযোগ থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ ও কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে প্রার্থী বাছাই করার। একই সঙ্গে তার ভোটের ওপরেই নির্ভর করবে কে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে ও সরকার গঠন করবে। এটাই একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অন্যতম প্রধান শর্ত। কেননা এর মধ্য দিয়েই একজন নাগরিকের ‘এজেন্সি’ কিংবা কর্তাসত্তা বোধ তৈরি হয়। এই সুযোগ না থাকলে নাগরিকের ভোটের আর কোনো কার্যকারিতা থাকে না, ক্ষমতাসীনেরা তাদের নিজস্ব স্বার্থকে নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেয়। ফলে রাষ্ট্রে আর নাগরিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না, নাগরিকেরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশের নবীন ভোটাররা এদিক থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে, এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সকল অর্থেই বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা দেশ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নবীন নাগরিকের ‘বিলংগিং’ অর্থাৎ যুক্ততার বোধ কিংবা অস্তিত্বের অংশ বোধ করার ক্ষেত্রে ভয়ংকর ছেদ ঘটায়। এটা বিপজ্জনক—রাষ্ট্রের জন্যও, ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি তরুণের জন্যও।
এই বাস্তবতা রাষ্ট্রের গতিমুখও নির্ধারণ করে দেয়। গণতন্ত্রের প্রধান যে উপাদান জবাবদিহি, নির্বাচন সেই জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র বিষয় না হলেও নির্বাচন না থাকলে কোনো জবাবদিহিই থাকে না। গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে রাষ্ট্র ও সরকার হয়ে ওঠে অধিকতর ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিসর ছোট হয়ে আসে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলীয়কৃত হয়ে পড়ে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, এমনকি ন্যায়বিচারও প্রভাবিত হতে থাকে। দুর্নীতি ও অপচয় সর্বব্যাপী চেহারা নেয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে যে বিপুল দুর্নীতি ও অপচয়ের অভিযোগগুলো সাক্ষ্য–প্রমাণসহ গণমাধ্যমে এসেছে, সেটা ঘটতে পারার অন্যতম কারণ সরকারকে কোনো প্রকৃত নির্বাচনে মুখোমুখি হতে হচ্ছে না, কথা শুনতে হচ্ছে না। ফলে সবকিছু জবাবদিহিহীন হয়ে উঠছে, দুর্নীতি লাগামছাড়া হতে পারছে। এই দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কারণে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পুরো দেশ একটা গভীর অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে।
এর ফলাফল দাঁড়ায় সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই তরুণদের জন্য বিপুল প্রতিবন্ধকতার বাড়বাড়ন্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, উন্নত ও মানবিক নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য, দূষণরোধী ব্যবস্থাপনাসহ কর্মসংস্থানের মতো সমস্যা এর সমাধানে তরুণদের যে অধিকতর সৃজনশীল উদ্ভাবনী অংশগ্রহণ দাবি করে, তার উল্টো চিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে। এসব খাতে বিপুল কর্মসংস্থানের যেমন সুযোগ আছে, তেমনি আছে দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা। যোগ্য তরুণদের অভাবও নেই দেশে, যারা দেশে ও বিদেশে এসব বিষয়ে উপযুক্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রেই দেখব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাগুলো থেকে উদ্যোক্তা তরুণদের বাদ দিয়ে, বঞ্চিত রেখে আমলাতান্ত্রিক উপায়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে তরুণেরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁদের উপযুক্ত বিকাশ থেকে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে তরুণেরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি খাতসহ পোলট্রি, হ্যাচারি, কৃষি খাতে বিপুল অগ্রগতি সাধন করেছেন। সব ক্ষেত্রেই দেখা যাবে তরুণদের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক উদ্যোগই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে সরকারের ভূমিকা ছিল তরুণদের বৈশ্বিক স্তরের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেওয়ায়।
রাজনীতির ক্ষেত্রও এর বাইরে কিছু নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ তরুণ শ্রমিক, শহর ও গ্রামের শ্রমজীবী কিংবা ‘প্রিকারিয়েট’ অর্থাৎ অনিশ্চিত শ্রম বিক্রেতার দলভুক্ত। এই তরুণদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের যা কিছু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কিন্তু ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাও কার্যকর না থাকায় দলবদ্ধ হয়ে, ইউনিয়ন গঠন করে নিজেদের পেশাগত দাবিগুলো সামনে আনতেই কেবল দুস্তর বাধার মুখোমুখি তারা নয়, নিতান্ত বেঁচে থাকার শর্ত পূরণের দাবি নিয়ে পাঁচ বছরে একবার রাস্তায় নামলেই কপালে জোটে রাষ্ট্রের গুলি। এমনকি ছাত্র তরুণদের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি যুগ যুগ ধরে কেবল ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকেই তাঁরা বঞ্চিত নন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা ভ্যাটের বিরুদ্ধে কিংবা কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, রাজনৈতিক পরিসরে তার জায়গা হওয়ার বদলে হেলমেট বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। একইভাবে দেখি জাতি-ধর্ম কিংবা লিঙ্গীয় পরিচয়ের প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর আরও প্রান্তিক হয়ে যেতে।
সন্দেহ নেই এই পরিপ্রেক্ষিত তরুণদের জন্য দেশের ভেতরে আশাবাদী ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য এক বড় আকারের চ্যালেঞ্জ। সে কারণেই সম্ভবত নানা সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ৪২ ভাগ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চান ভবিষ্যতের আশায়। বেকারত্ব, স্বাধীনতাহীনতা কিংবা কেবল অনুগত থাকাই যখন পরিণতি, সেখানে দেশ যোগ্য নাগরিকদের স্থান দেবে কীভাবে?
উল্লিখিত বিতর্কের ওই আয়োজনে তরুণেরা কিন্তু এ নিয়েও ভেবেছেন। তাঁদের একজন বলেছেন:
‘আমাদের চারপাশে এখন হাজার রকমের সমস্যা আছে। এগুলোর অনেকগুলোই সমাধান হয়ে যায়, যদি আমরা সঠিক জায়গায় সঠিক কথাটা বলতে পারি।’
সঠিক জায়গায় সঠিক কথা বলার জন্যই মানুষের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দরকার, দরকার তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, দরকার জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির আওতায় আনা, দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকার। এই গণতান্ত্রিক অধিকার একটা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আর তার জন্য অপরিহার্য এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাড়া কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?
এই প্রশ্নে আবারও তরুণদের ওপরই আমাদের ভরসা রাখতে হবে। যে জনগোষ্ঠী ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে স্বাধীনতাসংগ্রামে পরিণত করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি রাষ্ট্রপত্তন করেছে, যে জনগোষ্ঠীর তরুণেরাই ওই সংগ্রামের অগ্রসেনানি ছিলেন, সেই জনগোষ্ঠীর বর্তমানের তরুণদেরকে ভাবতে হবে এই রাষ্ট্রের বিদ্যমান গতিমুখে তাঁরা কোন অবস্থান নেবেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনে মাথা নুয়ে থাকা, নাকি নিজের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিতে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হওয়া? এই প্রশ্নটিই আজকের দিনে তরুণ জনগোষ্ঠীর সামনে একটি বড় কর্তব্যের আহ্বানকে সামনে নিয়ে এসেছে। জাতীয় দুর্যোগে যুগে যুগে তরুণেরাই তো সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
জোনায়েদ সাকি, প্রধান সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন