৫ সিটি নির্বাচন: ফাঁকা মাঠে গোল না শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা!

মাসখানেক আগে রাজশাহী ও সিলেট গিয়েছিলাম প্রথম আলোর সুধী সমাবেশ ও জিপিএ-৫ উৎসবে যোগ দিতে। আমরা যারা নিত্য যানজট ও অপরিচ্ছন্ন ঢাকা শহরে বাস করি, তারা শহর থেকে বের হলেই একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। রাজশাহী ও সিলেট শহরও একসময় অপরিচ্ছন্ন ছিল। রাস্তাঘাট অপ্রশস্ত ছিল। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনের দক্ষ নেতৃত্বে দুটি শহর যেমন পরিচ্ছন্ন হয়েছে, তেমনি বেড়েছে নাগরিক সেবাও। রাজশাহীতে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। একজন আওয়ামী লীগের ও অপরজন বিএনপির।

শনিবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় যখন পাঁচ সিটির মধ্যে তিনটিতে প্রার্থী পরিবর্তন ও দুটিতে সাবেক বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়, আমরা অবাক হইনি। পাঁচ সিটির মধ্যে রাজশাহীতে বর্তমান মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান ও খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক আবার মনোনয়ন পেয়েছেন।

রাজশাহীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, খায়রুজ্জামানের কাজ নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও স্বীকার করেন যে তাঁর সময়ে রাজশাহী শহরে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তিনি পদ্মার পাড় ঘিরে ১১ কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছেন, শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে নানা প্রকল্প নিয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে শহরে নতুন যে বাইপাসটি হয়েছে, তাতে যানজট অনেক কমেছে।

প্রথম আলো শিরোনাম করেছিল, ‘শহরের চোখ খুলে দিয়েছে যে সড়ক’। এ রকম চোখ ও মন খুলে দেওয়া আরও অনেক প্রকল্প আছে। খায়রুজ্জামানের অনুসারীদের কেউ কেউ চেয়েছিলেন, তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। কিন্তু দল শেষ পর্যন্ত তাঁকে সিটি মেয়র পদেই রেখে দিল। খুলনার উন্নয়নে তালুকদার খালেক উল্লেখযোগ্য কিছু না করলেও আওয়ামী লীগ তাঁর ওপর ভরসা রেখেছে। বিকল্প প্রার্থী নেই।

অপর তিন সিটিতে আওয়ামী লীগ নতুন মুখ নিয়ে এনেছে। বরিশালে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও গাজীপুরে আজমত উল্লা খান। ক্ষমতাসীন দলের দুজন মেয়র বাদ পড়েছেন। সাদিক আবদুল্লাহ ও জাহাঙ্গীর আলম।

২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ আজমত উল্লা খানকে বাদ দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে বেছে নিয়েছিলেন। এর অর্থ সেখানে তাদের বিকল্প কোনো প্রার্থী নেই। জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি মেয়র পদ হারান ও দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার হন। পরে দলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলেও তিনি আর মেয়র পদে মনোনয়ন পেলেন না। এখন বলছেন, নগরবাসী চাইলে তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহ প্রায় পাঁচ বছর মেয়র পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেনি। বর্ধিত এলাকায় উন্নয়নকাজ হয়নি। আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র হিরন শহরকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন। এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। শহরে যানজট বেড়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে দলকে মেয়র বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদেরও পাত্তা দিতেন না।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সিলেটে যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিল, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, তিনি পাস করতে পারেননি। মেয়র হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। একটানা ১০ বছর তিনি মেয়র পদে আছেন। ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কামরান মারা যান। ধারণা করা গিয়েছিল, সিলেটে যাঁরা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কেউ মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু দল বেছে নিল প্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। কয়েক মাস আগে তিনি দেশে ফিরে নিজেকে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী দাবি করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সুনজরে দেখেননি।
পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেখে মনে হলো, তারা দুই সিটিতে নিজেদের মেয়রকে ‘পরিত্যাজ্য’ ঘোষণা করল। আরেকটিতে দলের পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে প্রবাসী নেতাকে এনে নতুন পরীক্ষা দেওয়াচ্ছে।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, বিএনপি যদি সিটি নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে অনড় থাকে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে কোনো সমস্যা হবে না। বিএনপির বাইরে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল হলো জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন। এদের সাংগঠনিক ভিত্তি কিংবা প্রার্থীর ভাবমূর্তি কোনোটাই আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো নয়। সে ক্ষেত্রে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া অসম্ভব হবে না।

সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দুই মত আছে বলে জানা যায়। একাংশ নির্বাচনে অংশ নিয়ে (হোক সেটি নামে বা বেনামে) সরকারকে বৈধতা দিতে নারাজ। আরেক অংশ মনে করে, যেহেতু তাদের শক্তিশালী প্রার্থী আছে, স্বতন্ত্র হিসেবে হলেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ নেওয়া উচিত। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তারা ভালো ফল করবেন। আর নির্বাচনে কারচুপি হলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের দাবি যৌক্তিকতা পাবে

কিন্তু বিএনপি যদি তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসে এবং দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা না দেয়, তাহলে আওয়ামী লীগের ‘খবর’ আছে। দলের মনোনয়ন বোর্ড বিএনপির ঘোষিত অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মাথায় রেখেই দুই সিটির মেয়রকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়েছে ধারণা করি। সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেটাই দেখাতে চাইবে।

যে পাঁচ সিটিতে নির্বাচন হচ্ছে, প্রতিটিতে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী আছেন। বরিশালে মুজিবুর রহমান সরওয়ার ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরীকে টেক্কা দেওয়ার মতো নেতা আওয়ামী লীগে নেই। খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুও হতে পারেন শক্তিশালী প্রার্থী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির সময়েও তিনি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে এই পাঁচ সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো মেয়রপ্রার্থী জিততে পারেননি। সব কটি পেয়েছিল বিএনপি। ২০১৮ সালে সিলেট ছাড়া বাকি চারটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হলেও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ছিল। সিটি নির্বাচন কেমন হয়েছে, তার কিছু নমুনা সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার লিখিত ‘নির্বাচননামায় পাওয়া যাবে।

বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা তৈমুর আলম খন্দকার লড়েছিলেন চার বারের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে। তারপরও ভালো ভোট পেয়েছিলেন। আর কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন বিএনপির দুই নেতা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হলেও বিএনপির দুই প্রার্থীর যৌথ ভোট ছিল তার প্রায় দেড় গুণ। নির্বাচন কেবল শক্তির পরীক্ষা নয়, কৌশলেরও।

সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দুই মত আছে বলে জানা যায়। একাংশ নির্বাচনে অংশ নিয়ে (হোক সেটি নামে বা বেনামে) সরকারকে বৈধতা দিতে নারাজ। আরেক অংশ মনে করে, যেহেতু তাদের শক্তিশালী প্রার্থী আছে, স্বতন্ত্র হিসেবে হলেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ নেওয়া উচিত। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তারা ভালো ফল করবেন।

আর নির্বাচনে কারচুপি হলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের দাবি যৌক্তিকতা পাবে। সম্প্রতি সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছেন। নির্বাচনে বিষয়ে তিনি সিগনাল দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। সেই সিগনালটি নির্বাচনের পক্ষে না বিপক্ষে শিগগিরই জানা যাবে।
বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকলে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে। কিন্তু বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলে আওয়ামী লীগকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি