উশর বা ফসলের জাকাত, একটি ফরজ ইবাদত

রমজান মাসে জাকাত দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৫)

ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল ফসলেরও জাকাত রয়েছে। ফসলের জাকাতকে ‘উশর’ বলে। উশর মানে হলো দশ শতাংশ (১০ %)।

প্রাকৃতিক পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ হলো ‘উশর’ অর্থাৎ এক দশমাংশ। সেচের পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ ‘নিসফ উশর’ অর্থাৎ ৫% (পাঁচ শতাংশ)।

কোনো ভূমি যদি একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পানি দ্বারা চাষ করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ফসলের জাকাত ‘উশর’ ও ‘নিসফ উশর’ এর মাঝামাঝি হিসেবে ৭.৫% (সাড়ে সাত শতাংশ) দিতে হবে; অথবা ১০% ও ৫% এর মধ্যবর্তী যেকোনো পরিমাণ আদায় করলে হবে।

সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বৃষ্টির পানি, প্রবাহিত ঝরনার (নদীর) পানি ও মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা দ্বারা যে ফল-ফসল উৎপাদিত হয়, তার দশ ভাগের একভাগ (১০%) এবং সেচের মাধ্যমে যে ফল-ফসল উৎপাদন করা হয়, তার বিশ ভাগের এক ভাগ (৫%) জাকাত প্রদান করতে হবে।’ (বুখারি: ১৪১২, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৪০; তিরমিজি: ৬৩৯, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩১)

প্রাকৃতিক উপায়ে আহরিত মধু ও সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের ‘উশর’ (১০%) এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা মধু ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা লবণে ‘নিসফ উশর’ (৫%) প্রদান করতে হয়। ফসলের জাকাত ‘উশর’ গরিবের পাওনা হক (অধিকার) ফরজ ইবাদত। ‘উশর’ ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক আদায় করতে হয়; বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়।

কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) এমন যে যিনি সৃজন করেছেন বাগান সুউচ্চ (মাচানে লতানো) ও অনুচ্চ (মাচানবিহীন) এবং খেজুর বৃক্ষ ও খেত; তার স্বাদ বিভিন্ন, আর জলপাই ও ডালিম, যেগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য আছে, বৈসাদৃশ্যও আছে। তোমরা খাও তার ফল যখন ফল পরিপক্ব হয়; আর তার হক (উশর) প্রদান কোরো তা উত্তোলনের দিনে; আর (উশর প্রদান না করে) সীমা লঙ্ঘন কোরো না, নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৪১)।

‘আর তোমাদের জন্য ভূমি হতে আমি যা (ফসল) উৎপন্ন করি, তা হতে ব্যয় করো (উশর আদায় করো)।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৭) উশর ও জাকাত ফরজ ইবাদত যা মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকেরা দেশের কল্যাণে অংশগ্রহণ করার জন্য জাকাতের বিকল্প হিসেবে জিজিয়া (কর) প্রদান করবে এবং ফসলের জাকাত তথা উশরের পরিবর্তে ভূমি কর বা খাজনা (খারাজ) প্রদান করবে।

সকল প্রকার ফল ফসলের ‘উশর’ প্রদান করতে হবে, তা যে পরিমাণই হোক এবং যেই প্রকারেরই হোক। (মুখতাসারুল খিলাফিয়্যাতিল বায়হাকি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৫২) সংরক্ষণযোগ্য ফল-ফসল নিসাব পরিমাণ (২০ মণ) বা এর বেশি হলে তবেই উশর সরকার আদায় করবে। এর কম হলে বা স্মরণযোগ্য না হলে মালিক নিজেই প্রদান করবেন।

যেসব উৎপাদনের উশর প্রদান করতে হয়—   (১) ফলফলাদি; যেমন খেজুর, আঙুর, আম, জাম, কাঁঠাল, তরমুজ ইত্যাদি (২) শাকসবজি; যেমন লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, বেগুন, আলু, কচু ইত্যাদি (৩) মসলা; যেমন পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, সয়াবিন ইত্যাদি (৪) খাদ্যশস্য যেমন ধান, গম, যব, ভুট্টা, ইত্যাদি এবং (৫) ফসল; যেমন শণ, পাট, তুলা, রেশম, আখ, লবণ ইত্যাদি।

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে সব মুসলিম নাগরিকের জমিই উশরি ছিল। খলিফা হজরত উমর (রা.) শুধুমাত্র যুদ্ধ-বিজিত ভূমিতে ‘খারাজ’ বা কর আরোপ করেন। এতে মুসলিম ফকিহরা একমত হয়েছেন, মুসলিম মালিকানাধীন কোনো ভূমিতে খারাজ বা ভূমিকর আরোপ করা যাবে না; শুধু বিজিত দেশের অমুসলিম নাগরিকদের ভূমিতে খারাজ আরোপ করা হবে। ইমাম আবু ইউসুফ (র.) বলেছেন, ‘যে সকল ভূমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সে সকল ভূমি উশরি।’ (আল মাবসূত)।

মুসলিম বিজয়ের সময় মালিকহীন, পরিত্যক্ত বা পতিত ভূমি যা পরবর্তীকালে মুসলিমরা মালিকানা লাভ করেন বা ব্যবহার করেন; সে সব ভূমিও উশরি হিসেবে গণ্য। মুসলিম শাসক কর্তৃক মুসলিম নাগরিককে চাষাবাদের জন্য প্রদত্ত ভূমি এবং মুসলিম কর্তৃক আবাদকৃত সব ভূমিতে উশর প্রযোজ্য। সে মতে বাংলাদেশের সব ফসলি ভূমি উশরি। তাই এই সব ভূমির উৎপাদনের উশর প্রদান করা জরুরি।

‘উশর’ সে সকল খাতে ব্যয় করা যায়, জাকাত যে সকল খাতে ব্যয় করা যায়।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
    যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
    সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
    [email protected]