একজন সামিয়া ও একটি রঙিন ছাতা

সামিয়া বিনতে সারোয়ার

খররৌদ্র তাপে একপশলা বৃষ্টি এসে সব ভিজিয়ে গেল। প্রকৃতি যেন কিছু হলেও তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বৃষ্টি নামলেই চোখের সামনে একটা রঙিন ছাতা ভেসে ওঠে। ছাতার নিচে পরির মতো একটা ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটা হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে। একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ছাতা মাথায় হেঁটে যাওয়া সেই মেয়েটাকে আমি অনুসরণ করতে থাকি। সে আমার সমস্ত অনুভূতির মধ্যে মিশে থাকে, কিন্তু তাঁকে রক্তমাংসের এই হাত দিয়ে ছুঁতে পারি না। সে বৃষ্টিস্নাত কল্পনার মধ্যে উদয় হয়ে আবার কেমন করে যেন মিলিয়ে যায়।

আমার চোখে সারাক্ষণ লেগে থাকা এই মেয়েটির নাম সামিয়া। সামিয়া বিনতে সারোয়ার। সে আমার আত্মজা। এই কিছুদিন আগেও সে ছিল বাস্তবে। একটা দুঃস্বপ্নের মতো দুর্ঘটনা তাঁকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। কিন্তু আমার সমস্ত কল্পনা আর অনুভবে সে মিশে আছে।

মনে পড়ছে, আমার ছোট্ট মেয়ে সামিয়া তখন সবে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। তীক্ষ্ণ মেধাবী, চঞ্চল কিন্তু সরলতায় ভরা মুখ। বন্ধুবৎসল হওয়ায় স্কুলের গাড়ির সব আপুই তার বান্ধবী। সেই ছোট্ট থেকেই নানান বই পড়া তার পছন্দের বিষয়। তার শ্রোতা তার বড় আপু আর স্কুলে যাওয়া গাড়ির সঙ্গীরা। পথের লম্বা সময়কে এক প্রকার আনন্দময় করেই সে ঘরে আসত। তার চোখে কখনো ক্লান্তি দেখিনি। সবকিছুই তার যেন আনন্দে ভরা।

স্কুলব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে আমার গলা ধরে হেলেদুলে বলে, ‘আম্মু, ক্লাস টিচার বলেছে, “তোমাদের কার কী হবি, কে কী পছন্দ করো। ” আমি বলেছি, “কার্টুন, আমি কার্টুন পছন্দ করি”। আর টিচার বলে, “তুমি তো নিজেই একটা বার্বি ডল। তোমার তো কার্টুন পছন্দ হবেই। আমার অনেক লজ্জা লেগেছে। ”’

বৃষ্টির সামান্য ছিটা তার জামায় লেগেছে। আমি মুচকি হাসলাম। টেবিলের ওপর ব্যাগের পাশে তার রঙিন ছাতা। পছন্দটা সুন্দর, হালকা বেগুনির ওপর ছোট-বড় নানান ফুল। দুদিন হলো, আব্বুর সঙ্গে মার্কেটে গিয়ে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বর্ষার দিন হলে ব্যাগে তার ছাতা নিতে ভুল হয় না। যত্ন করে তার ছাতাটি সব সময় নিয়ে আসে, হারিয়ে যায় না। অথচ তার ভাই-বোন কত ছাতা হারিয়ে ফেলে। পরে অনুভব করলাম, ছাতা তার খুব শখের আর পছন্দের একটা জিনিস।

তার আরেকটা কাজও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। মাঝে মাঝে দেখতাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে গরিব মানুষকে দেখলে, কেউ সাহায্য চাইলে ওপর থেকেই টাকা ফেলে দিত। সেই মেয়েটি আমার স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে হঠাৎ পৃথিবী ছেড়েছে। বেঁচে থাকে অনেক শান্তি দিয়েছে মেয়েটি আমার।

তিন বছর ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ায় ক্লাস ফাইভে তাকে পড়তে হয়নি। আমার সেই মেধাবী মেয়েটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএতে (ব্যাচ ২২) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ২০১৮ সালে বেড়াতে গিয়েছিল কক্সবাজার। সে বছরের ২৪ আগস্ট পথে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় সে আর ফিরে আসেনি। পরে তার রেজাল্ট হয়েছে। সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।

আজ সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারি বিরাজমান। চারদিকে গরিব মানুষের অভাব আর চাওয়া বেড়েছে। প্রায়ই বারান্দা দিয়ে তাদের টাকা দিই। আর অনুভব করি এ যেন আমার হাত নয়, আমার প্রাণপ্রিয় সামিয়া মণির হাত। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে সোজা সূর্য যেখানে অস্ত যায়, সেখানেই আমার মেয়ের কবর। ঠিক সেই দিকটাই রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে। আমি প্রায়ই তা দাঁড়িয়ে দেখি। আর সালাম পাঠাই আমার সামিয়াকে। যেখানে সে চিরনিদ্রায় আছে। ছোট্টবেলায় কত চটপট আর দুরন্ত ছিল, এখন কত শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। অঝোর ধারায় প্রকৃতিতে যখন বৃষ্টি নামে, তখন ভাবি তার কথা।

বৃষ্টি বা ঝড় এলে সবার আগে দৌড়ে যেতাম তার ঘরে। বৃষ্টির ছিটা গায়ে লাগে কি না। তার রুমটা পশ্চিমা ঘেঁষা। রোদ আর আলো-বাতাস বেশিই আসত রুমে। এখন মেয়ে আমার প্রকৃতির রোদ আর বৃষ্টিতে ঘুমায়।

রোদের তাপটা আজ একটু বেশি। জানালার পাশে সাজানো তার সেই নানান রঙের তিন-চারটা ছাতা। কাজের মেয়েটা কাজ শেষ করে বলে, ‘খালাম্মা, একটা ছাতা দেবেন? অনেক রোদ।’ আমি সেখান থেকে একটা ছাতা দিয়ে বলি, ‘নাও, এটা আর ফেরত দিতে হবে না।’ মেয়েটি খুশিমনে নিয়ে চলে যায়। আমি পথের পানে তাকিয়ে থাকি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মেয়েটি হেলেদুলে যাচ্ছে আর প্রচণ্ড তাপ, তাকে রক্ষা করছে একটি ছাতা। আমার মেয়েটিও যেন থাকে এভাবে আল্লাহর আরশের ছায়ায়। আমিন।

হাফসা সারোয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সামিয়া বিনতে সারোয়ারের মা।