মো. সফিকুল হক চৌধুরী: স্বনির্ভর এনজিও প্রতিষ্ঠায় অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব

মো. সফিকুল হক চৌধুরী

বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন খাতে মো. সফিকুল হক চৌধুরী ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যে গুটি কয় মানুষের হাত ধরে বেসরকারি খাতে উন্নয়ন কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটে, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর উদ্ভাবন, উদ্যম ও সাফল্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা আশার কর্মকৌশল, ব্যাপকতা ও সাফল্য দেশের জন্য অনন্য সম্মান বয়ে আনে।

বহু বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের ললাটে জোটে শূন্যগর্ভ অর্থনীতি ও সীমাহীন দারিদ্র্য। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও খাত আত্মপ্রকাশ করে। এনজিও সংস্থাগুলো অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত এবং তলানিতে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে। সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশা অভূতপূর্ব কর্মোদ্যম, অঙ্গীকার ও কর্মনিষ্ঠা নিয়ে লাখ লাখ মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়।

মো. সফিকুল হক চৌধুরী ১৯৭৮ সালে আশা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে সাড়ে চার দশক পেরিয়েছে। আশা এখন বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশেষায়িত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। টানা দুই দশক ধরে আশা প্রায় ৭০ লাখের বেশি সেবাগ্রহণকারীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অন্যান্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আশার সেবাগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ৭২ লাখের ওপরে। খানাভিত্তিক হিসাব করা হলে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ আশার গৃহীত কর্মসূচির সুফল ভোগ করছে।

ব্যবস্থাপনার নবতর কৌশল উদ্ভাবন ও তার সফল প্রয়োগের মাধ্যমে মো. সফিকুল হক চৌধুরী একটি অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেন। তাঁর এ উদ্ভাবন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রেরণা তৈরি করে।

কীভাবে মো. সফিকুল হক চৌধুরী আশার মতো একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়তে সক্ষম হলেন? এর পেছনে তাঁর দর্শন কী ছিল? মো. সফিকুল হক চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে আসেন, যা তাঁর চিন্তাকাঠামো আমূল বদলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে তিনি তৎকালীন পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লায় যোগদান করেন। ফলে তিনি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেশা ও তাদের জীবনযাপন প্রণালি গভীরভাবে অবলোকন ও উপলব্ধি করার সুযোগ পান। দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষদের যাপিত জীবনের বিড়ম্বনা তাঁকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। যদিও তিনি জন্মেছিলেন একটি সচ্ছল পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভূস্বামী, যার ২০০ বিঘার বেশি আবাদি জমি ছিল। ফলে কখনোই তাঁকে আর্থিক টানাপোড়েন পোহাতে হয়নি। সেই মানুষ পরবর্তী জীবনে দরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়নকে নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।

এখানে তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক। তিনি ১৯৭৩ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন পরে সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বেসরকারি সংস্থার কাজে ফিরে যান। সেই প্রেক্ষাপটে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সরকারি চাকরি না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, যা তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ও ইস্পাতকঠিন মনোবলের পরিচয় বহন করে।

আশা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষদের অধিকার আদায় ও সংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। আশির দশকে আশা অতিদরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা ও তাদের জীবনমানের উন্নয়নে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করে। সেসব কর্মকাণ্ড ছিল বিদেশি দাতানির্ভর। তবে বিদেশি অনুদানকে তিনি কখনোই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, বিদেশি অনুদান ও সহায়তা একটি জাতি স্বাবলম্বী হতে পারে না। তাই নিজস্ব সম্পদ অর্জন ও তার ওপর ভিত্তি করে আর্থসামাজিক উন্নয়নকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তাঁর এ দর্শন আশাকে পুরোপুরি আত্মনির্ভর ও স্ব-অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। ২০০০ সাল থেকে আশা সম্পূর্ণভাবে বিদেশি অনুদানমুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই তিনি আশার কার্যক্রমে আমূল পরিবর্তন আনেন। দাতানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে আশা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করে। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনায় অনভিজ্ঞ আশার পক্ষে এটি ছিল সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব ও মানসিক দৃঢ়তার কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই আশা দেশের প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মধ্যে অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়।

এখানেই মো. সফিকুল হক চৌধুরীর দূরদর্শিতা ও নেতৃত্ব খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। তিনি আশা মডেলকে সহজ, গ্রাহকবান্ধব ও ব্যয়সাশ্রয়ী করে গড়ে তোলেন, যা একদিকে সেবাগ্রহণকারীদের দ্রুত ও সহজে আর্থিক সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে আশা দ্রুত গড়ে ওঠে টেকসই ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। টেকসই ও সবচেয়ে কার্যকর ক্ষুদ্রঋণ মডেল উদ্ভাবন এবং তার সফল প্রয়োগ আশাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এনে দেয়। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিন আশাকে বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ও টেকসই এমএফআই হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা ছিল আশা তথা বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবময় অর্জন।

মো. সফিকুল হক চৌধুরী তাঁর কাজকে দেশের সীমার গণ্ডিতে আটকে রাখেননি। তিনি আশা মডেলকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভারতের বেসরকারি সংস্থা ‘বন্ধন’ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে আশার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগত সহায়তা চেয়ে আবেদন করে। আশা অভিজ্ঞ কর্মী পাঠিয়ে এবং কারিগরি জ্ঞান দিয়ে বন্ধনকে বিপুলভাবে সহায়তা করে। ফলে মাত্র কয়েক বছরের বন্ধন ভারতের শীর্ষ এনজিওতে উন্নীত হয়। এর কারণ বন্ধন আশার ক্ষুদ্রঋণ মডেল সর্বাত্মকভাবে গ্রহণ করে অবিকলভাবে প্রতিস্থাপন করে। এ ছাড়া ফিলিপাইনের কার্ড ব্যাংক ও লাইফ ব্যাংক আশার কারিগরি সহায়তায় দেশটির শীর্ষ এনজিও হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে।

মো. সফিকুল হক চৌধুরী ইউরোপ ও আমেরিকার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আশা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের ১৩টি দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে আশা ইন্টারন্যাশনাল-এ বাংলাদেশের শতাধিক ক্ষুদ্রঋণ বিশেষজ্ঞ কাজ করছে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে দেশে পাঠাচ্ছে।

বেসরকারি খাতে কর্মরতদের চাকরি অনেকটা অনিশ্চিত এবং যেখানে কর্মী ছাঁটাই একটি সাধারণ ঘটনা। তবে মো. সফিকুল হক চৌধুরী ছিলেন কর্মী অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ। গুরুতর আর্থিক অনিয়ম বা বেআইনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হলে তিনি কর্মীদের চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে ছিলেন, যা তাঁর মানবিক মনের পরিচয় বহন করে। এই নীতি অনুসরণ করেই আশা ২৫ হাজার কর্মীর এক সুদক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছে। কর্মীরাই আশার সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সারা বিশ্বের ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে আশার কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয়।  

স্বল্পকালের জন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এই স্বল্প সময়ের দায়িত্বে তিনি সরকারি কাজে ভিন্নতার স্বাক্ষর রাখেন। আশার মতো একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং দেশ–বিদেশে সুনাম ও খ্যাতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মো. সফিকুল হক চৌধুরী ছিলেন একজন প্রচারবিমুখ মানুষ। প্রচারের আলো থেকে তিনি সব সময় দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনে তাঁর বিপুল অবদান সাধারণের কাছে অনেকটা অজ্ঞাত ও অজানা রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, আমি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করি, তাদের জন্য কিছু করতে পারাটাই আমার পরম প্রাপ্তি, অন্য কিছু নয়।

এই অনন্যসাধারণ মানুষটি ২০২১ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। অবহেলিত, বঞ্চিত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের কল্যাণে আত্মনিবেদনের এক অসাধারণ উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেছেন। এ কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

  • হাবিবুর রহমান জয়েন্ট ডেপুটি ডিরেক্টর, আশা