চোখে দেখিনি একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম, অনেক শত্রুসেনাকে খতম করব। দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্নডানায় চড়ে, লাল–সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র করে আনন্দমিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!
আহারে, শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয় গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসে-খেলে ঘুরে বেড়াই, জোছনাভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে। আনন্দ-সুখ-দুঃখ একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ।
সেই মা-মাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, খুব কাছের প্রতিবেশী শহীদ গাজী আবদুস ছবুর। যিনি যুদ্ধ শেষে মায়ের কাছে ফেরেননি। ১২টি বছর প্রতীক্ষায় ছিলেন শহীদ ছবুরের মা ছমেরাজ খাতুন। শেষনিশ্বাসটি চলে যাওয়ার সময়ও ছেলেকে খুঁজে বেরিয়েছেন তিনি।
ছবুর শহীদ হওয়ার পর তাঁর স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলতে চেয়েছে একটি পক্ষ। তাঁর কবর পাহাড়ে রয়ে গেছে। তাঁর গ্রামেও হয়নি কোনো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। পটিয়া শহরের অনেকে আজও জানেন না শহীদ ছবুর কে?
৩০ লাখ শহীদের একজন শহীদ গাজী আবদুস ছবুর। গাজী আবদুস ছবুর ১৯৫১ সালে ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া পৌরসভা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শেয়ানপাড়ার গাজীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত গাজী আলী চান সওদাগর পেশায় একজন লবণ ব্যবসায়ী এবং মাতা ছমেরাজ খাতুন। ১৯৭১ সালে ২ অক্টোবর পটিয়া কেলিশহরে রাজাকারের বিরুদ্ধে অপারেশনে গিয়ে সহযোদ্ধা পটিয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সামশুদ্দিন আহম্মেদের পাশেই শহীদ ছবুর শাহাদাতবরণ করেন।
পটিয়া কেলিশহরের ভট্টাচার্য হাট এলাকার গুরটিলা পাহাড়ের পাদদেশে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। কেলিশহরের খিল্লাপাড়ার টিলা পাহাড়ের কবরস্থানে। ১৯৯৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকায় পটিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। একদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কালাম চাচা আমাকে শহীদ ছবুরের কবর দেখাতে নিয়ে গেলেন। সেদিন কালাম চাচার মুখে শুনেছিলাম শহীদ ছবুরের গল্প। সে সময় থেকে আমার খুব কৌতূহল ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা-শহীদদের সম্পর্কে জানার, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গল্প শোনার। ছাত্রজীবনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে এবং পটিয়া বন্ধুসভার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আয়োজন করা হয়েছিল বহুবার। প্রায় ১৬ বছর ধরে শহীদ ছবুরের অজানা গল্প কুড়োনোর চেষ্টা করেছিমাত্র। তাঁকে নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লিখেছি, ‘একাত্তরের শহীদ ছবুর’ নামে একটি বইও লিখি তাঁকে নিয়ে। এসব প্রকাশের পর শহীদ ছবুর সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারল।
পটিয়ায় শহীদ ছবুর রোড সবাই চিনত। কিন্তু শহীদ ছবুরকে কেউ চিনত না। সে সময় সুহৃদ আরিফের পরামর্শে কজন বন্ধু মিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাত্তরের শহীদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ খুলি। গ্রুপটিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য আমরা কাজ করতাম। এই কাজে আমাকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষক কাজী সোহেল ও তার ছাত্রছাত্রীরা।
লেখালেখি হওয়ার পর শহীদ ছবুরের নামে পটিয়া কেলিশহরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ইশকুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট হরিসাধন দাদা।
একাত্তরের শহীদ ছবুর গ্রুপের পক্ষ থেকে দাবিদাওয়া করার পর শহীদ ছবুর স্মৃতিবিজড়িত রাহাত আলী ইশকুল মাঠে শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। পটিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শেয়ানপাড়া পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘শহীদ ছবুরের’ নামে পটিয়ায় প্রথম শিশুতোষ পাঠাগার স্থাপন করা হয়। পাঠাগারটি উদ্বোধক ছিলেন দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সবিহ্ উল আলম।
লেখালেখি করে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন শহীদ ছবুরের পরিবারের পাশে থাকা এবং ধৈর্যের ফল নাকি বড় মিষ্টি হয়। গত ২ অক্টোবর ২০২১ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরীর পরামর্শ দেন পরিবারের পক্ষ থেকে ভাতার জন্য আবেদন করা হয়।
কত চড়াই–উতরাই পার হওয়ার পর দীর্ঘ ৫১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ৯ মে শহীদ ছবুরের নাম গেজেটভুক্ত হয় এবং ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর শহীদ ছবুরের বোন জাহেদা আপা, জরিনা আপা এবং সহোদর গাজী সেলিম ভাইয়ের হাতে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার বই এবং রেশন কার্ড তুলে দেওয়া হয়। ভাতা কার্ড এবং রেশন কার্ড পেয়ে শহীদের ভাইবোন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শহীদ পরিবারে সবাই আনন্দে আত্মহারা, ৫১ বছর পর তাঁদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
প্রিয় পাঠক! শুধু এটুকু বলব, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অসম্মান করবেন না। যাঁরা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কিংবা না–ফেরার দেশে চলে গেছেন, তাঁদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করবেন। প্রত্যাশা করি, শহীদ ছবুরের নামে তাঁর গ্রামে ‘একাত্তরের চেতনা ও শহীদ ছবুর স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি। পরিশেষে বিনম৶ শ্রদ্ধা জানাই একাত্তরের শহীদ ছবুরসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সবাইকে।
রশীদ এনাম
লেখক ও সদস্য বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী।