১৯৮৪ সালের মার্চ মাস। আমি একজন নবীন বিসিএস অফিসার, তৎকালীন সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (কোটায়) আইন প্রশিক্ষণ কোর্সের একজন অংশগ্রহণকারী। ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি ড. ফজলুল হাসান ইউসুফ কোটার অধ্যক্ষ।
১৯৬৯ ব্যাচের সিএসপি ড. সা’দত হুসাইন কোটার পরিচালক। আমাদের উত্তম প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো অফিসার হিসেবে গড়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের চেষ্টার শেষ নেই। নবীন অফিসারদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং ভালো কাজের শিক্ষা ও দীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
কোটার অবস্থান ছিল শাহবাগে, পিজি হাসপাতালের পশ্চিম পাশে। তখন রাস্তায় তেমন যানজটও ছিল না। সম্ভবত মানুষের বিবেকবোধ ও কর্তব্যপরায়ণতাও এখনকার চেয়ে ভালো ছিল। তখন কেউ কোনো কাজের দায়িত্ব নিলে দরদ দিয়ে করতেন। তখন দায়সারাভাবে কাজ করে দিন পার করার প্রবণতা কম ছিল।
কোটার চেষ্টা ছিল সেরা অতিথি বক্তাদের নিয়ে আসা এবং আমাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ করে দেওয়া। আমাদের আইন প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে অতিথি বক্তা/শিক্ষক হিসেবে আসেন গাজী শামসুর রহমান, জেড এ শামসুল হক প্রমুখ সেরা আইনবিশারদ শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন অনন্যসাধারণ। তিনি ছিলেন সুদর্শন ও হাস্যোজ্জ্বল। কাপড়চোপড়ে ছিলেন বেশ রুচিশীল। তিনি ছিলেন একজন উঁচু মানের জ্ঞানী মানুষ। তাঁর পড়ানোর ধরন ছিল বেশ প্রাণবন্ত। আইন নীরস ও জটিল বিষয়। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল বেশ সহজবোধ্য ও উপভোগ্য। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতাম।
তিনি আমাদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি ছেলে প্রশিক্ষণার্থীদের ‘বাবা’ ও মেয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের ‘মা’ ডাকতেন। তাঁর এমন ডাকে হৃদয় নিংড়ানো স্নেহাশিস ছিল। তাঁর এ ডাক আমাদের হৃদয়কেও স্পর্শ করত। তিনি আমাদের পিতৃস্নেহে শিক্ষা দিতেন। আমরাও তাঁকে ভালোবাসতাম। তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল উইন উইন। আমরা ছিলাম পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধায় সিক্ত।
তিনি তখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের একজন, খুব ব্যস্ত মানুষ। আদালতের কাজ ফেলে তাঁকে আসতে হতো। ওই কাজে আয়রোজগার বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের পড়াতে আসতেন। তিনি ফুলটাইম শিক্ষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন অতিথি শিক্ষক। তবে তিনি শিক্ষাদানকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। তাঁরও ব্রত ছিল আমাদের ভালো বিচারক হিসেবে গড়ে দেওয়া। তাই তিনি কোটায় আসতেন, দুর্বোধ্য সাক্ষ্য আইনের পাঠকে সহজ উপায়ে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতেন।
তাঁর কাছে শেখা সাক্ষ্য আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিচারিক জীবনে বেশ কাজে লেগেছে। এজলাসে বসে সাক্ষ্য নেওয়া এবং খাসকামরায় বসে সাক্ষীর জবানবন্দি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সময় তাঁকে মনে পড়ত, তাঁর প্রোট্রেটটা চোখে ভেসে উঠত। তাঁর ‘বাবা’ ডাকের পুরোনো স্মৃতিটা নতুন করে হৃদয়কে স্পর্শ করত, তাঁর প্রতি মায়া হতো। সম্ভবত এখানেই শিক্ষকতার সার্থকতা, আর এমনটাই আদর্শ শিক্ষকের পাওনা। শিক্ষকতার মেয়াদ আছে। কিন্তু শিক্ষকের মেয়াদ ও মৃত্যু কোনোটাই নেই। শিক্ষক দৈহিকভাবে মারা যান। কিন্তু তাঁর দেওয়া শিক্ষার বার্তা কখনো বিলীন হয় না। এ বার্তা অনন্তকাল ধরে বহমান থাকে।
ব্যারিস্টার ড. রফিকুর রহমান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতা পেয়েছেন। অ্যাডভোকেট হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, বারের নেতা হিসেবে, সব জায়গায় তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক দিকপাল। তিনি খুব সময়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। একেবারে সেকেন্ডের কাঁটা ধরে ক্লাসে ঢুকতেন, সেকেন্ডের কাঁটা ধরে বের হতেন। আমাদের সমাজে এখন এমন মানুষের অভাব প্রকট। আমার প্রিয় শিক্ষক রফিকুর রহমান স্যারের প্রতি আবারও গভীর শ্রদ্ধা।
আমার যে শিক্ষকের কথা বলছি, তিনি ২০২৪ সালের ৩ জুন মারা গেছেন, কিন্তু তিনি আমাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। তাঁর শিক্ষার বাণী ও প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অসংখ্য অফিসারের স্মৃতিতে অটুট আছে ও থাকবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার প্রিয় শিক্ষককে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করুন, এ কামনা করি।
আমার প্রিয় শিক্ষকের নাম বিচারপতি ব্যারিস্টার ড. রফিকুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন, ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। তিনি ১৯৮০-১৯৮১ এবং ১৯৯১-১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং বিচারিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিথি বক্তা ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র বিচারপতি, সচিব, মন্ত্রিপরিষদের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আইনবিষয়ক অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি একজন সৎ, সদালাপী, বন্ধুবৎসল ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিলেন। তাঁর সহধর্মিণী ড. নাসিমা রহমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নিয়মিত সদস্য।
বিচারপতি রফিকুর রহমান ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর ঢাকা জেলার দোহার উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা লুৎফর রহমান সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তিনি কলকাতায় চাকরি করতেন। সেই সুবাদে রফিকুর রহমান কলকাতার রিপন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ব্যারিস্টার ড. রফিকুর রহমান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতা পেয়েছেন। অ্যাডভোকেট হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, বারের নেতা হিসেবে, সব জায়গায় তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক দিকপাল। তিনি খুব সময়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। একেবারে সেকেন্ডের কাঁটা ধরে ক্লাসে ঢুকতেন, সেকেন্ডের কাঁটা ধরে বের হতেন। আমাদের সমাজে এখন এমন মানুষের অভাব প্রকট। আমার প্রিয় শিক্ষক রফিকুর রহমান স্যারের প্রতি আবারও গভীর শ্রদ্ধা।
পণ্ডিত চাণক্যের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করা যায়। চাণক্য বলেছেন, কোনো শিক্ষক যদি কোনো শিক্ষার্থীকে একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, পৃথিবীতে এমন কোনো সম্পদ নেই, যা দিয়ে শিক্ষকের ঋণ শোধ করা যায়।
রফিকুর রহমান স্যারের ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আমার অথবা আমাদের কারোরই নেই। তবে আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করতে পারি।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে, তাঁর কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। আসুন, আমরা সবাই তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করি। ৯৪ বছর ৭ মাস ২ দিনের জীবনে তিনি দেশ, জাতি এবং আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন, আসুন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত হই।
এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার
সাবেক সচিব, লেখক ও গবেষক