আধুনিক অর্থনীতির জনককে নিয়ে বাংলাদেশে চর্চা নেই কেন

আধুনিক অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথের জন্ম ১৭২৩ সালে। সে হিসাবে তাঁর জন্মের ত্রিশতবার্ষিকী (টেরসেন্টেনারি) উদ্‌যাপিত হলো সম্প্রতি ৫-১০ জুন। মূল অনুষ্ঠানগুলো হয়েছে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ও এডিনবরা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁর জন্মস্থান কার্কডিতে। এ ছাড়া স্মরণসভা ও তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা হয়েছে, মেক্সিকো, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পিকিং, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বুথ স্কুল, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, ইউনিভার্সিটি অব কেন্টসহ সারা দুনিয়ার নামজাদা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এমন কোনো তৎপরতার খবর পাইনি। পাওয়ার কথাও নয়।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিসিরা কেউ ১০ টাকায় চা-শিঙাড়া-সমুচা-চপ বিক্রির গৌরব নিয়ে, কেউ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে ব্যস্ত। আর আমাদের অর্থনীতিবিদের অনেকেই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কনসালটিং বা সরকারের উন্নয়ন সাফল্যের উপাত্ত খনন নিয়ে ব্যস্ত, অ্যাডাম স্মিথের উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁদের ভাবার সময় কোথায়? এ লেখার মাধ্যমে আমি আমার সহ-অর্থনীতিবিদদের বিস্মরণের দায়বোধ খানিকটা লাঘব করার চেষ্টা করব।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

অ্যাডাম স্মিথ ১৭২৩ সালে স্কটল্যান্ডের কার্কডিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পাঁচ মাস আগে তাঁর বাবা মারা যান, যিনি ছিলেন একজন আইনজীবী ও শুল্ক কর্মকর্তা। তিনি তাঁর মা মার্গারেট ডগলাসের আশ্রয়ে বড় হন। শিশুকাল থেকেই স্মিথ ছিলেন ভীষণ মেধাবী, পড়ুয়া ও বিদ্বান ছাত্র। ১৪ বছর বয়সে তিনি মাকে ছেড়ে নৈতিক দর্শন পড়তে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে অধিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাকি জীবন তিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, মহাকাশবিদ্যা, ন্যায়শাস্ত্র, আইন, রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়ন ও শিক্ষকতা করে কাটান। তিনি শিক্ষাবিদ হিসেবে বেশির ভাগ সময় এডিনবরা ও গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কিছুটা সময় গৃহশিক্ষক হিসেবে ফ্রান্স ও বিলেতে কাটান।

জীবদ্দশায় তাঁর দুটি বই বের হয় দ্য থিওরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস (১৭৫৯) ও সমধিক পরিচিত দুই খণ্ডে ৭০০ পৃষ্ঠার অ্যান ইনকোয়ারি ইন টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস, যা লিখতে তাঁর ১৭ বছর লেগেছিল।

দ্য থিওরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস বইতে তিনি ‘অদৃশ্য হাত’ এর ধারনাকে উপস্থাপন করেন, মুক্ত বাজার কীভাবে প্রতিযোগিতা, চাহিদা ও সরবরাহ ও স্বীয়-স্বার্থ অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তা তুলে ধরেন এবং মানব প্রকৃতির জটিলতা ও সমমর্মিতা (এমপ্যাথি) অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করেন। দ্বিতীয় বই ওয়েলথ অব নেশনস–এ তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতি ও মুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আহ্বান জানান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখনকার নিয়মানুযায়ী তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলি তিনি মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তাঁর কিছু বক্তৃতার নোট পাওয়া যায় এবং তা প্রকাশিত হয়।

চিন্তাধারার স্থায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। অনেক সাময়িকভাবে জনপ্রিয় চিন্তাধারাই তাদের ধারকদের মৃত্যুর সঙ্গে বা অব্যবহিত পরেই সমাহিত হয়েছে। অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন তার ব্যতিক্রম। কারণ, তিনি কিছু চিরায়ত প্রশ্নের জবাব দিতে চেয়েছেন, যা এখনো প্রাসঙ্গিক—সমাজে বাজার ও রাষ্ট্রের ভূমিকা, স্বীয় স্বার্থের প্রাধান্য এবং নৈতিক আচরণের চালিকা শক্তি হিসেবে সমমর্মিতার আবশ্যকতা।

স্মিথের আবির্ভাব

স্মিথের সময়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাধারা ছিল ‘মার্কেন্টালিজম’। স্বর্ণভান্ডার বাড়িয়ে দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করাই ছিল অর্থনীতির লক্ষ্য। তাই আমদানি কমাতে ও রপ্তানি বাড়াতে হবে। শিল্পের প্রতিরক্ষণ (প্রটেকশনিজম) ছিল কাঙ্ক্ষিত নীতি। কীভাবে পণ্য উৎপাদিত হয় বা উৎপাদনের পেছনে মানবিক অনুপ্রেরণা বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। স্মিথ এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে লেখেন, ‘স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য নয়, বরং শ্রম দিয়েই বিশ্বের সব সম্পদ প্রাথমিকভাবে কেনা হয়।’

স্মিথ মার্কেন্টালিস্টদের ধারণার ভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, স্বীয় স্বার্থই অর্থনীতির চালিকা শক্তি—‘কসাইয়ের, বিয়ার বা রুটি প্রস্তুতকারকের বদান্যতা নয়, বরং তাদের স্বীয় স্বার্থের কারণে করা কাজের ফলে আমাদের খাবার টেবিলে রাতের খাবার আসে।’ নারীবাদীরা তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। নারীবাদীরা তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অ্যাডাম স্মিথের রাতের খাবার আসে তাঁর মা মার্গারেট ডগলাসের বদান্যতায়। শেষ হাসি অবশ্য অ্যাডাম স্মিথের, কেননা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাস ও খাবার প্রস্তুতে মায়েদের ভূমিকা হ্রাস, গৃহকর্মীর গুরুত্ব তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা প্রমাণ করে। শ্রমবিভাজনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অর্থনীতিতে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন

তিনি সামন্তবাদ ও দাসপ্রথার সমালোচনা করেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তিনি উচ্চ মজুরি ও স্বল্প মুনাফার পক্ষে মত দেন। তিনি স্বজনতোষণ, রাজনীতির করপোরেট দুর্বৃত্তায়ন, সাম্রাজ্যবাদ, শ্রমিকশোষণ ও ধনবৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যর্থ হওয়ার জন্য বেশি বড়’ হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর দ্য থিওরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস বইয়ে উচ্চবিত্তদের উপাসনা ও দরিদ্রের অবহেলাকে নিন্দা জানিয়ে এটাকে তাঁর সময়ের নৈতিক অনুভূতির বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অথচ ডানপন্থী অর্থনীতিবিদেরা, যেমন মিল্টন ফ্রিডম্যান ও জর্জ স্টিগলার তাঁর ‘অদৃশ্য হাত’ বক্তব্যকে মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে ও সরকারের নাক গলানোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। যাঁরা মনে করেন স্মিথ অর্থনীতিতে সরকারের কোনো ভূমিকাই দেখেননি, তাঁরা স্মরণ করতে পারেন যে স্মিথ তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কর আদায়কারী (ট্যাক্স কালেক্টর) হিসেবে কাজ করেছেন! 

কিছু কিছু মার্কিন অর্থনীতিবিদ তাঁকে বাজার মৌলবাদী (মার্কেট ফান্ডামেন্টালিস্ট) হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। অথচ তিনি বাজারকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নকশা তৈরি করতে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে স্বীয় স্বার্থ বিকশিত হয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারে। সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে সুবিধা ও অতিরিক্ত মুনাফা আদায়কারী ব্যবসায়ীদের তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং ১৭৭০ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য তাঁদের দায়ী করেন। 

চিন্তাধারার স্থায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। অনেক সাময়িকভাবে জনপ্রিয় চিন্তাধারাই তাদের ধারকদের মৃত্যুর সঙ্গে বা অব্যবহিত পরেই সমাহিত হয়েছে। অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন তার ব্যতিক্রম। কারণ, তিনি কিছু চিরায়ত প্রশ্নের জবাব দিতে চেয়েছেন, যা এখনো প্রাসঙ্গিক—সমাজে বাজার ও রাষ্ট্রের ভূমিকা, স্বীয় স্বার্থের প্রাধান্য এবং নৈতিক আচরণের চালিকা শক্তি হিসেবে সমমর্মিতার আবশ্যকতা। তাই ত্রিশতবার্ষিকী পেরিয়ে, হাজার বছর পরও পঠিত, আলোচিত হবেন, পরম্পরাক্রমে দিকনির্দেশনা দেবেন আধুনিক অর্থনীতির এই জনক। তাই ত্রিশতবার্ষিকীতে এই শিক্ষাগুরুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব