নুরুল আনোয়ার: বেঁচে থাকবেন বিশুদ্ধ চর্চায়

নুরুল আনোয়ার

ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলে একদা স্রোতস্বিনী বিশাল নদ ব্রহ্মপুত্র, তার পাড় ঘেঁষে সার্কিট হাউস, একটা প্রাচীন গির্জা ও খেলার মাঠ। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি একদল কিশোর সাদা প্যান্ট, কাপড়ের জুতা এবং সাদা শার্ট পরে খেলছে টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ। ক্লাবের নাম কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব। যার অধিনায়ক নুরুল আনোয়ার। নুরুল আনোয়ারের বয়স বাড়তে থাকে। ওই দশকের শেষে ম্যাট্রিক পাস করেন আর হয়ে ওঠেন ক্রিকেটের এনসাইক্লোপেডিয়া। কোথায় কোন মাঠে কে কত সেঞ্চুরি করেছিল, কার ভুলে কোন দল জেতার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হেরে গিয়েছিল—এসবই এই তরুণের মুখস্থ।

আরেকটু বড় হয়ে ইংল্যান্ডের ধারাভাষ্যকার নেভিল কার্ডাস ও কলকাতার শঙ্করী প্রসাদ বসুকে চিঠি লিখতেন। ঢাকায় আসা কোনো ক্রিকেট খেলাই তাঁর কর্মসূচি থেকে বাদ যায়নি। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে পল্লবিত হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত, হাতেখড়ি হয় গৌড়পুর মহারাজার সভা গায়কের কাছ থেকে। মাথায় ঢুকেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীত। উপমহাদেশের বিখ্যাত সব রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ও গায়কের সঙ্গে যোগাযোগ এবং চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে। এমন সব চিঠিপত্র তিনি লিখতেন যে প্রাপকেরা সবাই অবাক হয়ে যেত।

এই ছোড়া এত কিছু জানেন কী করে? ময়মনসিংহ ছেড়ে তিনি আসবেন না। তাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। কিন্তু মননে জীবনযাত্রায় গহনে সর্বক্ষণ রবীন্দ্রসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকসংগীত এবং ক্রিকেট। ইতিমধ্যে জুটে গেল তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী, ভক্ত এবং আরেকটু পরে ছাত্রছাত্রী। বিভিন্ন দূরত্বে তিনি চলে যেতেন ছাত্রছাত্রীদের গান শেখাতে। শিশুদের সংগীত শেখানোর প্রবল ঝোঁক, তৈরি হয়ে গেল গানের স্কুল ফুলকী। ইতিমধ্যে ওয়াহিদুল হকের দৃষ্টি পড়ে তাঁর প্রতি। ওয়াহিদুল হকও তাঁর ঝোলাটি সঙ্গে নিয়ে যান ময়মনসিংহে নুরুল আনোয়ারের বাড়িতে। এ এক অবাক মানুষ! তাঁর স্মৃতিতে এত স্বরলিপি কী করে স্থান পায়?

সেই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির যে পুনরুজ্জীবন ষাটের দশকে তারও উজ্জীবকদের মধ্যে একটা স্থায়ী আসন তিনি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে যে শুধু অনুশীলন করবে, চর্চা করবে, অসংখ্য উৎসাহী শিশু-কিশোর-তরুণের উজ্জীবিত করবে কিন্তু একেবারেই প্রচারবিমুখ থাকবে। এমনকি ছাত্রছাত্রীদেরও সব সময়ে বলে থাকেন, মিডিয়ার আকর্ষণে তোমার সংগীতচর্চাকে ব্যাহত কোরো না। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন তিনি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে। কার্যোপলক্ষে বনস্পতির নিবিড় ছায়ায় আবিষ্কার করলেন আরেক আফ্রিকা। এ সময়েই তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু এই ডিগ্রি লাভে তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, আগ্রহ সংগীত ও ক্রিকেট।

অতিসম্প্রতি ৪ অক্টোবর দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে লোকান্তরিত হলেন নুরুল আনোয়ার। ঢাকা শহরের বসুন্ধরার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় একেবারেই সবার অলক্ষে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর প্রিয় জন্মস্থান ছিল ময়মনসিংহ, তাঁর প্রিয় জন্মভূমিকে ত্যাগ করে একসময় ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে ঢাকাকে তিনি সব সময় বলতেন এটি শুধুই একটি জীবিকাশ্রয়ী শহর।

এ ছাড়া যাবতীয় নৃতাত্তিক বিষয়ে তাঁর পরম আগ্রহ ছিল। স্মৃতিশক্তিও ছিল প্রখর। হয়তো একটা বিষয় একবার পড়লেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। ময়মনসিংহে ষাটের দশকে রাজনীতির এক প্রবল পরাক্রমের সময় বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনীতি এবং তার সঙ্গে সংস্কৃতিও। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ত্রিশের দশকে ময়মনসিংহ জেলার গ্রামাঞ্চলে যে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে তার একটা পুনর্জীবিত রূপ এই ষাটের দশকেই দেখা গেল। সেই সঙ্গে আলোকময় সাহাসহ অনেক সংগীতশিল্পী বাংলাদেশের হৃদয়কে নতুন করে আবিষ্কার করল। নুরুল আনোয়ার তাদের এক বড় প্রেরণা।

ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। নতুন ভাবনার সময় এসেছে। ময়মনসিংহে তার গৃহে আমরা আবারও ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে মিলিত হই। তর্ক-বিতর্ক, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, দেশের স্বপ্ন সবকিছু নিয়ে রাতের পর রাত কাটতে থাকে। কিন্তু পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর সবার মতো নুরুল আনোয়ারও দমে যান। দেখতে পান একটা বড় অপচ্ছায়া বাংলাদেশের ওপর ভর করেছে। কখনো নৈরাশ্য এসে ভর করে তাঁর মনে। কিন্তু সংগীতের অনুশীলন, ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা এসব চলতেই থাকে।

ছায়ানটের নেতৃত্বে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ গঠিত হয়। একসময়ে তাঁর গৃহে শৈলজা রঞ্জন আসেন। সেই আগমন এ দেশের সংগীতবিশারদদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নুরুল আনোয়ারও কলকাতা গিয়ে শান্তিদেব ঘোষসহ অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানকার পত্রপত্রিকায় লিখতেও শুরু করেন। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের ক্ষোভ এই মানুষকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আনা যায় না। ঢাকায় এলেও ১২ ঘণ্টার বেশি তিনি থাকতে চান না। সেটাই বোধ হয় সঠিক। কারণ, দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রতিভা ঢাকায় এমনভাবে আসতে শুরু করেছে যে ছোট ছোট শহরগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এই শূন্যতা এখন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

ঢাকার বাইরে থেকে যেসব শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রকর ঢাকায় এসে রাজধানীকে একদা সমৃদ্ধ করত, এখন সেই চর্চার ক্ষেত্রগুলো শূন্য হয়ে যাওয়াতে রাজধানীও একসময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। কারণ, ঢাকা এখন আর চর্চার জায়গা নেই, এখানে সবাই মিডিয়া আর অর্থের প্রতিপত্তির পেছনে ছুটছে। এই ছুটে চলা কোনো অবস্থাতেই নুরুল আনোয়ারের একেবারেই কাম্য ছিল না, স্থির অধ্যবসায় নিয়ে শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা এবং বিশুদ্ধ ক্রীড়া সংস্কৃতি তাঁর লক্ষ্য ছিল। আমরা যারা তাঁকে চিনি, তাঁর দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, চর্চা এবং আপসহীনতার সামনে অবনত হয়ে থাকতাম। তিনি অবশ্যই শুদ্ধ সংগীতচর্চা এবং বিশুদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।

অতিসম্প্রতি ৪ অক্টোবর দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে লোকান্তরিত হলেন নুরুল আনোয়ার। ঢাকা শহরের বসুন্ধরার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় একেবারেই সবার অলক্ষে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর প্রিয় জন্মস্থান ছিল ময়মনসিংহ, তাঁর প্রিয় জন্মভূমিকে ত্যাগ করে একসময় ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে ঢাকাকে তিনি সব সময় বলতেন এটি শুধুই একটি জীবিকাশ্রয়ী শহর। অসুস্থতা, স্ত্রীর চোখে নিরাময়ের অনুপযোগী ব্যাধি এবং কন্যাদের সাহচর্যের জন্য তিনি আসেন এই শহরে। নিভৃতচারী হিসেবেই তিনি বিদায় নিয়েছেন। এই মহৎ নিঃসঙ্গ মানুষটির প্রতি আমাদের প্রণতি।

  • মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব