পেশায় সালেহ চৌধুরী ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাংবাদিক। কিন্তু সাংবাদিকতার মধ্যেই তিনি তাঁর জীবন নিঃশেষ করেননি। তাঁর দেশপ্রেম ছিল অসাধারণ। পাকিস্তান আমলে ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
১৯৫২ সালে সালেহ চৌধুরী মৌলভীবাজার কাশীনাথ আলাউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের বুকে গুলি চলার পর সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার ঢেউ পৌঁছেছিল তৎকালীন সিলেটের সেই ছোট্ট শহরেও। তিনিও শামিল হলেন ছাত্রদের সেই সংগ্রামে। পুরোনো পত্রিকা সংগ্রহ করে বন্ধুদের সঙ্গে লিখলেন পোস্টার। সেঁটে দিলেন শহরের দেয়ালে দেয়ালে। মৌলভীবাজার পৌর পার্কে সফল ছাত্র সমাবেশে স্কুলছাত্র সালেহ চৌধুরীও যোগ দিলেন।
১৯৫০-এর দশকে সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে ছাত্র থাকাকালে সালেহ চৌধুরী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি চলে সাহিত্যচর্চা।
মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক অর্জনের পর সালেহ চৌধুরী বৃত্তি নিয়ে চলে যান লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাজকল্যাণে সাফল্যের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন ১৯৬৭ সালে। যোগ দেন সাংবাদিকতায়। এই ভূখণ্ডে তখন বিপুল রাজনৈতিক উত্তেজনা। ১৯৬৯ সালে সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়ান সারা দেশ। মুক্তির জন্য বাঙালির বুকের আগুন তাঁর বুকেও তখন জ্বলছে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রথমে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়িতে। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালাতে অভিযান শুরু করলে তিনি ঢাকা থেকে চলে যান সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে, নিজের গ্রাম গচিয়ায়। সেখান থেকে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
সালেহ চৌধুরী টেকেরঘাট সাব–সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। শাল্লা, দিরাই, জগন্নাথপুর, আজমিরীগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিশাল ভাটি এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণা সালেহ চৌধুরী করেছেন এভাবে:
‘পাথারিয়া বাজার থেকে আমার বাড়ি দু মাইল। ফাঁড়িপথে। সেবার আমন সম্ভবত ভালোই ফলেছিল। নাড়া–ঢাকা মাঠ দিয়ে হাঁটছিলাম। ঘড়িতে তখন চারটা বাজে। হঠাৎ মনে পড়ল, গত রাতে শুনেছিলাম চারটার দিকে হানাদাররা আত্মসমর্পণ করতে পারে।
হঠাৎ এক অদম্য আবেগ আমাকে পেয়ে বসল। এখনই হানাদাররা আত্মসমর্পণ করবে? আমরা বিজয়ী? আমার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, চোখ থেকে পানির ধারা নেমে আসবে।
‘সঙ্গে থাকা ছেলেদের এ দুর্বলতা দেখাব না। ওদের কোনোরকমে বললাম, সবাই বসে পড়ো। একটু জিরিয়ে নিই। আমি নাড়ার ওপর শুয়ে পড়লাম। বাঁধভাঙা ধারায় নেমে এল চোখের পানি। সময় লাগল নিজেকে সামলে নিতে।’
বিজয়ের পর মুক্ত সুনামগঞ্জে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে মিনার নির্মাণে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সালেহ চৌধুরী। এর নকশাও তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। যাঁদের রক্তে মুক্ত এ দেশ, এই বাণী ধারণ করে সেই শহীদ মিনার আজও সুনামগঞ্জের প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বাধীন দেশে সালেহ চৌধুরী ফিরে গেলেন তাঁর পুরোনো পেশা সাংবাদিকতায়। দৈনিক বাংলার শেষ দিন পর্যন্ত সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত থেকে অবসরে যান তিনি। কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রাণের তাগিদে নিভৃতে করে গেছেন লেখালেখি, সম্পাদনা, চিত্রাঙ্কন, কার্টুন, প্রচ্ছদ, ভাস্কর্য ইত্যাদি।
২০১৪-২০১৫ সালে যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সালেহ চৌধুরী গ্রহণ করেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে অর্থ দিয়ে শহীদ সহযোদ্ধাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলবেন। জীবিত অবস্থায় দুটি স্মৃতিস্তম্ভ তিনি নির্মাণ করে যেতে পেরেছিলেন। সহযোদ্ধাদের প্রতি ছিল তাঁর নিখাদ ভালোবাসা।
বই পড়তে তো ভালোবাসতেনই, বিশেষ অনুরাগ ছিল দাবা খেলায়। বিশিষ্ট লেখক কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতে গিয়েছিলেন দাবার জন্য স্থায়ী কিছু করার অনুরোধ নিয়ে। দাবা ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার সেটিই সূত্রপাত। বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ ছিলেন তাঁর পুত্রতুল্য। ‘দাবা ও নিয়াজ মোরশেদ’ নামে তাঁর একটি বইও আছে।
কবি শামসুর রাহমান ছিলেন সালেহ চৌধুরীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। কবির রচনা সংকলন ‘সেরা শামসুর রাহমান’ সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সালেহ চৌধুরীর স্নেহধন্য। হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু রচনা সংকলন তিনি সম্পাদনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর স্মারকগ্রন্থ ‘ধন্য সে পুরুষ’।
ছাত্রজীবনে সালেহ চৌধুরী ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, যদিও পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি। ভালোবাসতেন জন্মভূমি সুনামগঞ্জকে। অজুহাত পেলেই ঢাকা থেকে ছুটে যেতেন সুনামগঞ্জে।
সালেহ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
হাসান মাহমুদ তরুণ লেখক