‘কমনসেন্স’ বিচারকার্যের পথিকৃৎ এক বিচারকের গল্প

বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী (জন্ম ১৯৩৭–মৃত্যু ১৪ নভেম্বর ২০২২)
ছবি: সংগৃহীত

এই বিচিত্রা কার্যালয়ে প্রতি মাসে এক ভদ্রলোক নিয়মিত আসেন। চুপচাপ ঢোকেন। ঢুকেই প্রশাসন বিভাগের প্রধান রাশিদা বেগম আসমা অথবা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের  কক্ষের দিকে যান। খুব সাদাসিধে পোশাক, লম্বা ফুলহাতার শার্ট টেট্রন কাপড়ের ঢিলেঢালা প্যান্ট, হাতে একটি খাম, তা কখনো পত্রিকার ভাঁজের ভেতরে। একদিন আসমাই এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।

ভদ্রলোকের নাম মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, যিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। চা-পর্বের ভেতরে অল্প একটু কথা হয়েছিল আমাদের তিনজনের মাঝে। পরে বিচারপতি চলে গেলেন। আমি ওনার কিছু লেখা তত দিনে পড়েছি, ওনার নামধাম পত্রিকায় অনেকবার পড়েছি নানা আলোচিত মামলার রায়ের কারণে। বিচারপতি রাব্বানীর বিচিত্রায় নিয়মিত আসার উদ্দেশ্য ছিল দুটি: এর একটি ওনার লেখা দিয়ে যাওয়া আর অন্যটি লেখার বিল নিয়ে যাওয়া। উনি নিয়মিত লিখতেন এবং মাসে মাসে লেখার বিল নিতেন।

আসমা একদিন বিচারপতির বরাতে কথা প্রসঙ্গে জানাল, অনেকে মনে করতে পারে এত বড় একজন বিচারপতি, লেখার সম্মানী হিসেবে সামান্য কিছু টাকার জন্য উনি কেন এত কষ্ট করে নিয়মিত বিল নিতে আসেন। বিল নিতে আসার আগে খোঁজ নিতেন বিলটা হয়েছে কি না। উনি লেখার সম্মানী দিয়ে বাজারসদাই করতেন। টাকাটা ওনার দরকার হতো। এর থেকে আমরা কল্পনা করতে পারি ওনার সৎ সুন্দর সাদামাটা জীবনযাপনের গল্প এবং চিত্রগুলো।

উনি বিচারালয় আইন সংবিধানের নানা বিষয়ে মানবিক চোখে দেখা সত্যগুলো তাঁর  লেখা ও বিশ্লেষণে তুলে আনতেন। উনি বিচিত্রা ছাড়াও জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, আজকের কাগজ এবং আরও কিছু দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। জাতীয় প্রেসক্লাবসহ রাজধানীর দু-একটি জায়গায় জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু সভা-সেমিনারে তাঁকে দেখতে পেতাম, অনেক সময়েই দর্শকসারিতে সাধারণের একজন হয়ে চুপচাপ শুনতেন, এরপর নিভৃতে বেরিয়ে যেতেন।

গোলাম রাব্বানী ১৯৬০ সালে রাজশাহীতে আইন আদালতের সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়ে নিয়েছিলেন কেবল নিজের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নয়, তিনি প্রকৃত অর্থে মানুষের মুক্তির এবং স্বস্তির তালাশ করেছেন বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে এর সংকট চিহ্নিত করেছেন, সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন, দিয়েছেন সহজ সুন্দর বিশ্লেষণ।

শেষের দিকের বছরগুলোতে তাঁর লেখালেখির কোনো খবর আমি জেনে উঠতে পারিনি। একবার আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম ওনার কোনো খবর জানে কি না। আসমাও জানে না। এরপর ঢাকার গণমাধ্যমে কাজ করে এ রকম আমার কয়েকজন সহকর্মী এবং বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর খবর তাঁদের কাছে আছে কি না। ওনার লেখা কোথায় ছাপা হয়। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। আমিও আরও বেশি সংগত তৎপরতা দেখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। গুগলে খোঁজাখুঁজি করে দেখেছি ওনার কোনো সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় কি না।  এমনকি আমার দু-একজন গণমাধ্যমের বন্ধু সহকর্মীকে অনুরোধ করেছিলাম ওনার খোঁজ বের করে ওনার লেখাজোখা ছাপাতে। নিত্যব্যস্ত সাংবাদিকতায় আমার বন্ধুরাও বিচারপতি রাব্বানীর খোঁজ পাননি। মৃত্যুর পর কেবল অল্প কয়েক লাইনের প্রায় একই খবর সব কাগজে দেখে গণমাধ্যমের দায়সারা সংবাদ পরিবেশন দেখে মন খারাপ হয়েছে। এমতাবস্থায় দু-একটি গণমাধ্যমে ফোন করে জানতে চাইলাম বিচারপতি রাব্বানীর লেখা কাজ ও জীবনধারা সম্পর্কে তাঁদের হালনাগাদ ধারণা বা কতটুকু। আশাব্যঞ্জক সাড়া কোথাও পাইনি।

বিচারপতি রাব্বানীর প্রতি আমার এত আগ্রহ কেন? তাঁর সৎ জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম, যা তাঁর লেখার প্রতি আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিল। এরপর ওনার লেখার ভেতরে ঢুকে দেখি উনি সত্যানুসন্ধানে একরকম খনিশ্রমিকের মতো কলম ধরেন, পাঠকের উদ্দেশে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেন, ঠিক যেন শিশুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।

বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর জন্ম ১৯৩৭ সালে। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহীতে আইনজীবী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। ২০০২ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসর নেন। সব মিলিয়ে তাঁর বিচারক হিসেবে কর্মকাল এক দশক। এই এক দশকের বিচারকার্যে বিচারক হিসেবে তার অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করলে আমরা বুঝতে পারব তাঁর প্রভাব হাজার বছরের। তার কয়েকরটি উদাহরণ দিতে চাই।

মুসলিম বিবাহ আইনের সময়োপযোগী অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিচারপতি রাব্বানী তাঁর দেওয়া বেশ কিছু রায়ে। তাঁর দেওয়া দুটি রায় বাংলাদেশের বাইরেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

একটি রায়ে (হেফজুর রহমান বনাম শামশুন নাহার) বলা হয়েছিল, একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিলে তাঁকে প্রতিদিন উপযুক্ত ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন যত দিন না তালাকপ্রাপ্তা পুনর্বিবাহ করবেন, যদিও রায়টি পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ কর্তৃক বাতিল হয়।

আরেকটি রায় ফতোয়া প্রদান প্রসঙ্গে। এ রায়ে বিচারপতি রাব্বানী সিদ্ধান্ত দেন যে আদালত ছাড়া কোনো ব্যক্তি মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা কিংবা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। দেওয়ার অধিকারী নন। ফতোয়াসংক্রান্ত এ রায় জনস্বার্থে অনেক বড় দৃষ্টান্ত মনে করা হয়। পরিতাপের বিষয়, আপিলের রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ ফতোয়াকে বৈধতা দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়, তবে ফতোয়ার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া যাবে না।

বিচারপতি রাব্বানী উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই লিখে গেছেন, যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ভেতরের ক্রন্দন এবং বিচারকার্যের অন্দরে অলিগলির অন্ধকার সরানোর জন্য আলোর ঠিকানা রেখে গেছেন। সেই ঠিকানায় চাইলে আমাদের জাতিরাষ্ট্র এবং এর মানুষেরা পৌঁছাতে পারবে। তিনি সময়কে চিহ্নিত করে গেছেন ‘প্রশ্ন জিজ্ঞাসার’ কাল হিসেবে। তাঁর রচিত বইগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের দুঃখের বিচার, জার্নি উইদিন ইসলাম, ওকালতি ও জজিয়তি জীবনের জলরেখা, স্বাধীনতা, বাংলার যে মুখ আজীবন দেখিলাম, ছহি মুক্তিযুদ্ধনামা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান: সহজ পাঠ’ এবং বাংলাদেশের সংবিধানের বিকাশ ও বিচ্যুতি।

গোলাম রাব্বানী ১৯৬০ সালে রাজশাহীতে আইন আদালতের সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়ে নিয়েছিলেন কেবল নিজের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নয়, তিনি প্রকৃত অর্থে মানুষের মুক্তির এবং স্বস্তির তালাশ করেছেন বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে এর সংকট চিহ্নিত করেছেন, সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন, দিয়েছেন সহজ সুন্দর বিশ্লেষণ।
গোলাম রাব্বানী ১৯৬৯ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান এবং হাইকোর্টে আইনি পেশা চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সনদ লাভ করেন এবং ১৯৯২ সালে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অবধি তিনি আইন পেশায় সততা ও মানবিকতার সঙ্গে আইন পেশায় অবদান রাখেন।

এভাবে সংক্ষেপে তাঁর জীবন সম্পর্কে বলে দিলে তাঁর জীবনের তাৎপর্য প্রকাশ পাবে না। তিনি ছিলেন আদতে কাণ্ডজ্ঞানহীন সময়ের কমনসেন্স বিচারকার্যের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বিরল বিচারকদের একজন। বিচারপতি পরিচয়ের আড়ালে তাঁর আরেক পরিচয় তিনি একজন বড় মাপের লেখক। তাঁর লেখার মাঝে গভীর অন্তর্দৃষ্টি সত্যের চূড়ান্ত তালাশ এবং মিথ্যা জারিজুরির ফটকাবাজির বিরুদ্ধে এক কঠিন কণ্ঠস্বর। তা যেন লেখক শঙ্কর রচিত ‘কত অজানারে’ গ্রন্থের মতো। তাঁর বিচারালয় এবং বিচারকার্য নিয়ে অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর লেখাজোখায় যে গভীর অভিনিবেশ পাই, তার সঙ্গে তুলনা করা যায়।  

তাঁর লেখালেখি নিয়ে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যে কোনো কোনো দুষ্টচক্র রব তোলার চেষ্টা করেছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেহেতু ২০০৭-২০০৮ শাসনামলে রুজু করা মামলা বিচারাধীন, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে তা সংবিধানবিরুদ্ধ হবে।

এই দুষ্টচক্রের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। এরপর বিচারপতি রাব্বানী এই অধ্যাপককে জুতসই একটা শাসানি দিয়েছিলেন চমৎকার একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখে। এইভাবে তিনি ফটকাবাজ সুশীল আর বুদ্ধিজীবীর মুখে সংবিধান ঘেঁটে চুনকালি মেখে দিতেন দেশ ও মানুষের মঙ্গলের পক্ষে।

তাঁর জবানিতে জানা যায়, তিনি বিচারক হিসেবে যদি বুঝতেন মামলার মোড় ভুল দিকে যাচ্ছে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নির্দোষ মানুষ শাস্তির মুখে পড়ছে, বিচারক হিসেবে মানুষ হিসেবে তার ভেতরে রক্তক্ষরণ হতো। তিনি ভুল রায় এড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট উকিলদের নানা প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের মধ্যে প্রমাণ খুঁজে আনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারতেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। তাতে গহ্বরের মুখের শেষ আলোর ইঙ্গিত খুঁজে পেতেন আইনজীবীরা এবং নির্দোষ মানুষ শাস্তির ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেয়ে যেত। তিনি বিচারক হিসেবে ঠিক বাংলা প্রবাদবাক্যের মতোই ছিলেন, ‘দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’

এ রকম একজন মানুষ, মানবিক বোধ ও বিবেকের নজির বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ৮৫ বছর বয়সে পরপারে চলে গেলেন। রেখে গেলেন মানুষের সামনে আমাদের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ানোর, আলো জ্বালানোর দেশলাই। তাঁর বইগুলো এ রকম দেশলাইয়ের বাক্স। কীভাবে? এই পর্যায়ে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সংবিধান: বিকাশ ও বিচ্যুতি’ বই থেকে তাঁর একটি কথা উল্লেখ করে এই লেখাটি শেষ করছি:‘কী আশ্চর্য! যে দেশটির জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে দেশটির গড়ার কাজ শুরুই করা যায়নি।’

  • আনিসুর রহমান বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার, সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য