আমাকে হুমায়ুন আজাদ চেনানো সুব্রত দে মলয়

সুব্রত দে মলয়

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই আমাকে বারবার হল ছাড়তে বাধ্য করত তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন। একবার গেস্টরুমে নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছিলাম, আমি আওয়ামী-সমর্থক পরিবার থেকে এসেছি। এটাকে ঠিক সাহস বলা যায় না, উল্টোটা বললে সুবিধা হতো, সেই চালাকি আগে থেকেই শিখিয়ে দেওয়ার মতো কোনো অভিভাবক আমার ছিল না।

২০০৫ সালের সেই বসন্তের রাতে আমি চলে যাই জগন্নাথ হলে, আমাকে আশ্রয় দেন ছাত্রলীগ নেতা প্রণব দাশ বাবলু। সেই হল প্রাঙ্গণেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সুব্রত দে মলয়ের সঙ্গে। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে হল থেকে বিতাড়িত হয়েছি, সংবাদটি শুনে আমার প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

সরু দেহে সবল কণ্ঠের মলয় আমার চেয়ে কয়েক বছরের জ্যেষ্ঠ। সারা দিন রাজনীতিতে ব্যস্ত সময় কাটানো মলয় গায়ের মলিন টি-শার্টের একটা অংশ ওপরে টেনে মুখ মুছছিলেন। তখন তাঁর পেটের বাঁ পাশে দেখতে পাই আড়াআড়ি একটা দীর্ঘ পুরু ক্ষতের দাগ। আমি সেই আঘাতের কারণ জানতে চাই।

২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লেখক–অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হলে তার প্রতিবাদে প্রথম মিছিলে প্রথম স্লোগান ধরেছিলেন মলয়। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্র সংগঠনগুলোরও এই আন্দোলনে ছিল বলিষ্ঠ অবস্থান। আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি নেওয়া হয়। কয়েক শ ছাত্র–ছাত্রীর মিছিলটি শাহবাগ, টিএসসি ঘুরে হাইকোর্ট মাজার গেটে যাওয়া পর পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর শুরু হয় পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ। এক পুলিশ সদস্য এসে মলয়ের পেটে বুট চেপে ধরেন। সেই চাপে তাঁর পেট চিরে যায়। সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন মলয়। মলয়ের বর্ণনায় নিরাসক্তি থাকলেও সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার মনটা বীভৎসতায় ছেয়ে গেল।

তারপর থেকে সুব্রত দে মলয় ক্যাম্পাসে আরও অনেকের মতো আমারও আপনজন হয়ে ওঠেন। দেখা হলেই আমি তাঁর কাছে হুমায়ুন আজাদ স্যারের গল্প শুনতে চাইতাম। কখনো পেটের ক্ষতটা দেখতে চাইতাম, মলয় মানা করতেন না। টি-শার্ট কিছুটা ওপরে তুললে, আমি আঙুল দিয়ে সেলাইয়ের উঁচু-নিচু ব্যাপারটা স্পর্শ করে ঘটনার ভয়াবহতা আন্দাজ করার চেষ্টা করতাম।

আমি যে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তার আগের বছরের ঘটনা। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় চাপাতির কোপ খেতে হয় কবি হুমায়ুন আজাদকে। আমার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেটেছে হুমায়ুন আজাদের অনুপস্থিতি অনুভব করে। এই অনুপস্থিতি টের পেতাম চারপাশের ভেঙে পড়া দেখে, মলয়ের মতো রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত মানুষদের মুখে তাঁর কথা শুনে।

মলয়ের কাছেই আমি হুমায়ুন আজাদ স্যারের বেশ কিছু বইয়ের নাম জানতে পারি। মলয়ের প্রিয় বইগুলো দিয়েই যেন শুরু ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘বুকপকেটে জোনাকি পোকা’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’, ‘যতোই গভীরে যাই মধু/ যতোই ওপরে যাই নীল’, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ ইত্যাদি।

তাঁর মুখে ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কবিতাটির অংশবিশেষ শুনে একই সঙ্গে যৌনতা ও রাজনীতির পাঠ পেতাম, “আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ সবচে সুন্দর মেয়ে দুই হাতে টেনে সারা রাত/ চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল ঊরুতে/ গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী।” যতটুকু মনে পড়ে, তাঁর হাতেই প্রথম দেখেছিলাম ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ উপন্যাসটি। হুমায়ুন আজাদের রচনার চেয়েও কম জনপ্রিয় নয় তাঁকে নিয়ে নানা গালগল্প, ছাত্র-ছাত্রী কিংবা সহকর্মীদের উৎকণ্ঠা।

মলয় দেয়াল লিখতেন, ব্যানার লিখতেন। তাঁর একটা নিজস্ব টাইপোগ্রাফি ছিল। আর ছিল লাল রঙের প্রতি আস্থা। কী যে ভালো লাগল সেসব আমার! মলয়ের সতীর্থ বাংলা বিভাগের ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আজিজ হাসান গড়ে তুলেছিলেন ‘হুমায়ুন আজাদ সংসদ’। সেই সংসদে একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন মলয়।

হুমায়ুন আজাদের পাঠক-ভক্তদের অনেকেই আজ স্বৈরাচার-সমর্থক, মতপ্রকাশের বিরোধী। হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ভক্তদের বিপদে ফেলত। খুনি হত্যা করে একবার, কিন্তু ভক্ত তাঁর মানবকে হত্যা করে বছরের পর বছর। আজাদের খুনিরা পলাতক, আদালত রায় দিয়ে বসে আছেন।

একবার একুশ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মরণে সংসদের সদস্যরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার, তাই দরকার একটি ব্যানার। তখনো ডিজিটাল প্রিন্টের পিভিসি ব্যানারের চল আসেনি। নীলক্ষেত থেকে কিনে আনা হলো উজ্জ্বল সাদা কাপড় ও রং-তুলি। মলয়ের হাতের লেটারিংয়ে ছোঁয়া পেল নান্দনিক একটি ব্যানার। স্যার এফ রহমান হলের ভেতরে খোলা জায়গায় শীতের সেই গভীর রাতটা ছিল আড্ডা আর কাজের।

হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে কী হতো, তা-ই ছিল আড্ডার বিষয়বস্তু। এ দেশে মহৎ মানুষকে ঘিরে থাকে দুর্বৃত্তরা, আর অপেক্ষায় থাকে কখন তাঁর মৃত্যু হবে আর স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে মোম-আগরবাতি বেচবে।

হুমায়ুন আজাদের পাঠক-ভক্তদের অনেকেই আজ স্বৈরাচার-সমর্থক, মতপ্রকাশের বিরোধী। হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ভক্তদের বিপদে ফেলত। খুনি হত্যা করে একবার, কিন্তু ভক্ত তাঁর মানবকে হত্যা করে বছরের পর বছর। আজাদের খুনিরা পলাতক, আদালত রায় দিয়ে বসে আছেন।

হুমায়ুন আজাদ যে কারণে প্রথাবিরোধী, সেই প্রথাই তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর চিন্তাকে চর্চারহিত করে বানানো হয়েছে দিবসের কবি, বিতাড়িত হয়েছেন পাঠ্যসূচি থেকে খুনিদের, সমমনাদের দাবিতে। তিনি লড়েছেন যা কিছুর বিরুদ্ধে, তাই আজ তাঁকে দ্বিগুণ স্মরণ করে। নিঃসঙ্গ মুকুট কেড়ে নিয়ে দিয়েছে অনুকূল বাণিজ্যসম্ভব মর্যাদা।

আমাদের আরেক সতীর্থ শরীফ আরেফিন রনির সৌজন্যে পাওয়া গেল মলয়ের লেখা একটি কবিতা। পুরোনো কাগজপত্র ফেলে দিতে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটের একটা ছেঁড়া অংশে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল গোটা গোটা অক্ষরে মলয়ের হাতের লেখা, ‘কত দূর গেলে পরে স্পষ্ট হবে নীল/ ঢেউ ভাঙ্গে তাল ঢেউ থামে না/ তুমি ভাসো অদূরে, একা একা রোদ্দুরে/ বালুময় ভূমি সূর্যসারথি/ আমি ছুঁই না সমুদ্র ছোঁয় তোমাকে।’

মলয়ের হাতের লেখা ছিল দারুণ। তাঁকে একবার বলেছিলাম, আমার যখন কবিতার বই বেরুবে, প্রচ্ছদ এঁকে দিতে। নামলিপি হবে একেবারে সিঁদুরে লাল। মলয় বলতেন, ‘দেব...দেব...’।

কিন্তু মলয় চলে গেলেন আমার প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার ঠিক আগের বছর। ২০১১ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহসভাপতি সুব্রত কুমার দে মলয়। মলয়ের সঙ্গে দিনগুলো ছিল আমাদের যুগপৎ শিক্ষা ও মানস প্রস্তুতির কাল। এমন শিল্পসচেতন রাজনৈতিক সহকর্মীকে আমাদের মনে পড়ে।

  • মাজহার সরকার কবি ও কথাসাহিত্যিক। ই-মেইল: [email protected]