সাদি মহম্মদরা কেন আত্মহত্যা করেন

সাদি মহম্মদ

রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু ছিল একটি রোমান্টিক ধারণার মতো। তিনি যেন অধীর আগ্রহে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন।

মাত্র ২০ বছর বয়সে লেখা গীতিকবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।’

বস্তুত, মৃত্যু মানে কী অথবা জীবনের ওপারে কী আছে, তা দেখার জন্য ব্যাকুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে জন্যই ডাক্তাররা যখন দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব করলেন, তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমার ডাক এসে গেছে।’ ক্রিটিক বলছেন, তিনি যেন ওপারে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো ইংরেজি ভাষার অনেক কবির কাছেও মৃত্যু একটি রোমান্টিক আবহ।

কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর পরিবর্তে যাঁরা আত্মহননকে বেছে নেন, তাঁরা মনে করেন, ‘এ পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য।’ প্রতিভাধর ও সৃষ্টিশীল যে সব মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের সবাই পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করে যান, কেউ লিখে আবার কেউ-বা না লিখে।

তাঁদের মধ্যে যাঁদের জগৎ-জোড়া খ্যাতি ছিল, তাঁরা হলেন রুশ কবি মায়োকভস্কি, ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ আর মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। মার্কিন কবি অ্যান সেক্সটন যে কাব্যের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান, তার নামই ছিল, ‘বাঁচো অথবা মরো’।

দীর্ঘকাল ধরে চলা আবেগমথিত হতাশা আর মানসিক যন্ত্রণা থেকে লেখা কবিতা ‘মৃত্যুবরণ করতে চাই’-এ বলেন, মৃত্যু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এ কবিতা লেখার কিছুদিন পরই অ্যান সেক্সটন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে যবনিকা টানেন জীবনের।

পৃথিবী যদি বসবাসের অযোগ্য হয়, তার দায় সমাজের ও রাষ্ট্রের, সমাজে বসবাসরত সব মানুষের। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষের মনে সীমাহীন অভিঘাত তৈরি করে, যা একসময় মানুষকে আত্মহননে প্ররোচিত করে।

কার্ল মার্ক্স প্রদত্ত পুঁজিবাদের সংজ্ঞার মধ্যেই ‘শোষণ’ শব্দটি বিদ্যমান। পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরাও, এই ব্যবস্থায় যে শোষণ হয়—অস্বীকার করেন না। কারণ, মার্ক্সের ‘থিওরি অব সারপ্লাস ভ্যালু’ গাণিতিক প্রমাণসিদ্ধ। বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা-ও শোষণমূলক ও পক্ষপাতদুষ্ট।

বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা হলে, কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। কারও এগিয়ে যাওয়া আর কারও পিছিয়ে পড়া মানে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়া। এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠে গিয়ে নিচের দিকে আর ফিরে তাকান না।

আরও পড়ুন

যাঁরা নিচে পড়ে গেলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁরা আর মেলামেশা করেন না। উঁচুতে ওঠার পরেও প্রতিযোগিতা থামে না; বরং আরও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ব্যবধান আর ব্যবধানই সৃষ্টি করে নিঃসঙ্গতা। বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা আত্মহত্যার প্রধান কারণ।

সামাজিক বৈষম্য, ব্যবধান, নিঃসঙ্গতা মানুষকে যে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, পরিসংখ্যানও এর সাক্ষ্য দেয়। দক্ষিণ কোরিয়া একটি ধনী দেশ। কিন্তু ২০১৯ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, সেখানে আত্মহত্যার হার সমগ্র পৃথিবীতে চতুর্থ। কারণ, ধনের পাশাপাশি ধন-বৈষম্যও সেখানে প্রকট, যা মানুষকে নিঃসঙ্গ করেছে।

উত্তর কোরিয়া একটি দরিদ্র দেশ, জীবনে কোনো প্রাচুর্য নেই সেখানে বরং জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন কিন্তু সেখানে আছে সাম্যের নীতি, নেই ধনী-গরিবের তেমন ব্যবধান। আত্মহত্যার হারও সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর কোরিয়া থেকে যাঁরা পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন, তার একটা বড় অংশ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

সরকারের অনুকম্পা লাভই যেখানে পুরস্কারপ্রাপ্তির একমাত্র যোগ্যতা, সেখানে সাদি মহম্মদের মতো ‘সাধারণ’ মানুষের স্থান থাকে না রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের তালিকায়। এর চেয়েও বড় কষ্ট হয় তখন, যখন ঔৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানো একজন গুণী সাধক দেখেন, তাঁর চেয়ে অযোগ্য কোনো ব্যক্তি পুরস্কার পেয়ে গেছেন। এই কষ্ট আর অভিমান নিয়েই সাদি মহম্মদ জীবনের ইতি টেনেছেন।

মেয়েদের মধ্যে অনেকেই পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। বৈষম্যহীন জীবনে অভ্যস্ত তরুণ-তরুণীরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাঁরা জীবনের কাছে হেরে গেছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক সংযোগে বা ঘুষ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা আদায় নিশ্চিতভাবেই অবৈধ পন্থা। পুঁজিবাদী সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সামরিক–বেসামরিক আমলা, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে তোলে এবং তাঁদের পোষণ-তোষণ করে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর প্রধান ও অন্য অনেক পদ পূর্ণ হয় সরকার সমর্থক গোষ্ঠীর সদস্য দ্বারা।

জাতীয় পুরস্কারগুলো চলে যায় সরকার–সমর্থক বাহিনীর হাতে। দল ও দলপ্রধানের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যই এসব পুরস্কারের প্রধান যোগ্যতা। বস্তুত, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংযোগ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে সবকিছু সম্ভব করে দেয়—অবৈধ আয়, পদোন্নতি, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ইত্যাদি সবকিছু।

কোনো কিছুতে ঔৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছাতে হলে একজন মানুষকে গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ ছিলেন এ রকমই একজন সাধক। প্রতিদিন দীর্ঘসময় তিনি রেওয়াজ করতেন। তাঁর ছোট ভাই শিবলী মহম্মদ জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার কিছুক্ষণ আগেও গান গাইছিলেন সাদি মহম্মদ।

তার মানে, সংগীত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল তাঁর। যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ সংগীত আছে। সংগীতের প্রতি অনুরাগ শুধু নয়, সীমাহীন নিষ্ঠা ছিল তাঁর। গায়কি, শুদ্ধতা এবং গলার ওপর নিয়ন্ত্রণ বিশিষ্ট করেছিল তাঁকে। অথচ কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটেনি তাঁর।

বাংলাদেশে পুরস্কারপ্রাপ্তির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তাতে পুরস্কার পাবেন শুধু তাঁরাই, যাঁদের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংযোগ থাকবে। সরকারের অনুকম্পা লাভই যেখানে পুরস্কারপ্রাপ্তির একমাত্র যোগ্যতা, সেখানে সাদি মহম্মদের মতো ‘সাধারণ’ মানুষের স্থান থাকে না রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের তালিকায়। এর চেয়েও বড় কষ্ট হয় তখন, যখন ঔৎকর্ষের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানো একজন গুণী সাধক দেখেন, তাঁর চেয়ে অযোগ্য কোনো ব্যক্তি পুরস্কার পেয়ে গেছেন। এই কষ্ট আর অভিমান নিয়েই সাদি মহম্মদ জীবনের ইতি টেনেছেন।

আর কোনো সাদি মহম্মদকে যাতে আত্মহত্যা করতে না হয়, সে জন্য ধন-বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক সংযোগের দৌরাত্ম্য, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের উগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতেই হবে।

পুঁজির আগ্রাসনে মানবসভ্যতা যে বিপন্ন হবে, তা আশির দশকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা উদ্ধৃত করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার কবিতায় এত হতাশা কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘হতাশা নয়, অভিমান।’

কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া অবহেলারই নামান্তর, আর অবহেলা মানুষের মধ্যে অভিমানের জন্ম দেয় এবং এই অভিমান নিয়েই সাদি মহম্মদ স্বেচ্ছায় পৃথিবী থেকে ছুটি নিয়েছেন।

অন্তিমযাত্রায় ভক্তরা কী গান গাইবেন, সেই চিন্তা করেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ একটি গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের অন্তিমযাত্রায়ও আমরা সেই গানটি গেয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাই:

কে যায় অমৃতধামযাত্রী।

আজি এ গহন তিমিররাত্রি,

কাঁপে নভ জয়গানে ॥

আনন্দরব শ্রবণে লাগে, সুপ্ত হৃদয় চমকি জাগে,

চাহি দেখে পথপানে॥

ওগো রহো রহো, মোরে ডাকি লহো, কহো আশ্বাসবাণী।

যাব অহরহ সাথে সাথে

সুখে দুখে শোকে দিবসে রাতে

অপরাজিত প্রাণে ॥

  • ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail. com