আ গ্রামারিয়ান’স ফিউনেরাল

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।ছবি : সাইফুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’ করতাম বছর কুড়ি আগে। তবু ফোনে-ইনবক্সে এখনো অনুরোধ আসে বিপন্ন মানুষের। বন্ধু নীতিও একই কারণে খুঁজছিল। আমি কেঁপে উঠলাম।

আমাদের শিক্ষক তাসনীম সিরাজ মাহবুব ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যিনি গোটা দেশের কাছে প্রফেসর ইমেরিটাস, কথাসাহিত্যিক আর আমাদের, আমাদের আগের-পরের কয়েক প্রজন্মের কাছে এসএমআই স্যার, তাঁর রক্ত দরকার। বি নেগেটিভ।

আমি একমুহূর্তও দেরি করিনি। খোঁজখবর নিয়ে উঠতে না উঠতেই খবর এল রক্ত জোগাড় হয়েছে। সেই তো। এসএমআই স্যারকে কেন রক্তের জন্য একবিন্দু সময় অপেক্ষা করতে হবে! এটুকু করতে না পারা তো ‘পাপ’।

সেই থেকে স্যারের সেরে ওঠার ক্ষণগণনা আমাদের। স্যার অসুস্থ বলেই কি না কে জানে, এ বছর শিক্ষক দিবসে ঘুরেফিরে বারবার আমার প্রিয় শিক্ষকদের আনাগোনা মাথার ভেতর। সেই সিলেটের প্রায় ধসে পড়তে বসা বিনা বেতনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাঁর নাম আজ আর মনে নেই। শুধু একবার বকলে অনেকবার আদর করতেন বলে ‘তুলা স্যার’ বলে ডাকতাম। বিদ্যাময়ী স্কুলের নীলা সরকার। এত কড়া, এত—তবু স্নেহের আধার। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএমআই। কড়া ছিলেন না, স্নেহেরও কমতি ছিল না।

খুব খারাপ ছাত্রী ছিলাম। একটা রেকমেন্ডেশন লেটার দরকার। স্যার তিন পাতা লিখে দিলেন। ভালো ছাত্রছাত্রীদের জন্য লিখতে অত পাতার দরকার পড়ে না, ‘গুণধর’ ছাত্রীর ‘গুণ’ খুঁজে পেতে স্যারের কত চেষ্টা!

আরেকবার, আমি তখন বিবিসি বাংলায় কাজ করি। সবার সামনে বলেছিলেন, ‘সাবিহা, আমি কিন্তু তোমার টিউটোরিয়াল খাতা খুঁজে পেয়েছি।’ হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘স্যার, এখানেই থাক।’ হেসেছিলেন।

প্রশ্রয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইউ আর ডুইং আ স্প্লেনডিড জব।’ আমাকে আর পায় কে, আমি সপ্তম আকাশের চূড়ায়। কতবার কতভাবে স্যারের মুখ থেকে শোনা এই প্রশংসাটুকু ইনিয়ে-বিনিয়ে সবাইকে শুনিয়েছি!

প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করলাম, সব শিক্ষকই আসলে এক রকম— কড়া হোন বা নরম, টিপে টিপে নম্বর দিন বা হাতখুলে, সেই বিনে মাইনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাধ্যমিকের শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএমআই—তাঁরা সব সময় আমাদের মতো নগণ্য ছাত্রছাত্রীর পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়ান। যেকোনো বিপদে–আপদে তাঁদের স্নেহের হাত মাথার ওপর অনুভব করি আমরা।

কাকতালীয়ভাবে শিক্ষক দিবসেই স্যারকে প্রথম লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলো। পরদিন সকালে আমি হাসপাতালে গিয়ে বেশ খানিকটা সময় একাই সিসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শুনতে পেলাম কেউ একজন কাশছেন, কোনো একটা মনিটরে বিপ বিপ শব্দ, চিকিৎসক-নার্সরা ভেতরে ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন। আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম স্যার ঠিক কোনো জায়গাটায় আছেন। সাহস করে শেষমেশ একজনের কাছে জানতে চাইলাম, স্যারের শারীরিক অবস্থা কেমন? বললেন, ১১টায় জানা যাবে। আমার স্যার আসলে তখন যাত্রাপথে। গন্তব্য অজানা, হয় বাসায় ফিরবেন পরিবারের কাছে, নয়তো তিনি অনন্তে মিশে যাবেন।

মন ভার করে অফিসে ঢুকলাম। ঐকমত্য কমিশন, উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট বিতর্ক, ইলিশ বাঁচাতে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন—এমন সব খবরাখবর ছাপিয়ে আমার মাথায় সারা দিন ঘুরপাক খায় ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফর্ক’ কিংবা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’।

স্যারের কথা শোনার প্রয়োজন তো কখনো ফুরানোর নয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি কী করে হবে, এ নিয়ে একদিন দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। এই মরার দেশে, যেখানে সমানুভূতির এমন তীব্র সংকট, যেখানে অন্ধত্ব-অশিক্ষার এমন বিকট উদ্‌যাপন, সেখানে শিক্ষার উন্নতি ছাড়া মুক্তি কোথায়। আর ‌হ্যাঁ, তিনি যখন হাসপাতালের বিছানায় আমরা—তাঁর ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে স্মরণ করেছি, সে কথাও বলব। সেই সুযোগ স্যার দিলেন না।

সহকর্মী রাশিক তাবাসসুম মুজিবকে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে বসলাম ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’–এর সেই কেরানির কাজ করা নারীর কথা, ব্রণভরা মুখের প্রেমিকের জন্য যে নেহাত অনিচ্ছায় অপেক্ষা করে। কারণ, প্রেম আর বেঁচে নেই। প্রেমিক চলে গেলে নারীটি বলে, সে সুখী, কারণ সবকিছু চুকেবুকে গেছে। তারপর গ্রামোফোনে গান চড়িয়ে ‌অটোমেটিক হাতে চুল আঁচড়ে নেয়। এ–ই হলো শহুরে যান্ত্রিকতা। রাশিক কী বুঝল আমি জানি না, মাথা নাড়ল।

মনে হলো ‘ফোর কোয়ার্টেটস’টা নতুন করে পড়ি একবার। ভাবলাম, ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ পড়ি: ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট; দ্য সেন্টার ক্যান নট হোল্ড/ মেয়ার অ্যানার্কি ইজ লুজড আপন দ্য ওয়ার্ল্ড,/ দ্য ব্লাড-ডিমড টাইড ইজ লুজড, অ্যান্ড এভরিহয়্যার। দ্য সেরেমনি অব ইনোসেন্স ইজ ড্রউনড’। রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতাও পড়া যায়, ‘মাই লাস্ট ডাচেস’। স্যারের স্মরণ আমি আর কীভাবেই-বা করব। হঠাৎ মনে হলো ‘আ গ্রামারিয়ানস ফিউনেরাল’ কবিতাটার কথা। সেও এক শিক্ষকের শেষযাত্রার গল্প। ছাত্ররা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছেন শিক্ষকের মরদেহ, সেই সঙ্গে করছেন স্মৃতিচারণ। নিজেকে শাপশাপান্ত করলাম। ছি! এমন সময় কেন এই কবিতার কথা মনে পড়বে?

সুসংবাদ শুনলাম, স্যারের আর লাইফ সাপোর্ট লাগছে না। তিনি পরিবারের সবাইকে চিনতে পারছেন। সেরে উঠলেই তাঁর কাছে যাব ভাবলাম। স্যারের কথা শোনার প্রয়োজন তো কখনো ফুরানোর নয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি কী করে হবে, এ নিয়ে একদিন দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। এই মরার দেশে, যেখানে সমানুভূতির এমন তীব্র সংকট, যেখানে অন্ধত্ব-অশিক্ষার এমন বিকট উদ্‌যাপন, সেখানে শিক্ষার উন্নতি ছাড়া মুক্তি কোথায়। আর ‌হ্যাঁ, তিনি যখন হাসপাতালের বিছানায় আমরা—তাঁর ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে স্মরণ করেছি, সে কথাও বলব।

সেই সুযোগ স্যার দিলেন না। মনজুর স্যার যখন তাঁর শতসহস্র সন্তানকে পেছনে ফেলে অসীমের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন, তখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। বন্ধুদের হোয়াটস‌অ্যাপ গ্রুপে রবিউল লিখল, এমন মৃত্যুকেই বলে অকালমৃত্যু। বেরিয়েছিলাম। ঘরে এসে ‘ফোর কোয়ার্টেটস’ খুলে বসলাম। টি এস এলিয়টকে একটা পাখি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। এমন একটা বিন্দুর সন্ধান তিনি পেয়েছেন, যার কোনো আদি বা অন্ত নেই, ঘূর্ণন নেই—আবার স্থিরতাও নেই, উত্থান নেই—নেই পতনও। তাল-লয়-সুর নেই, তবু আছে প্রবলভাবে...।

  • শেখ সাবিহা আলম সাংবাদিক