বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুর এক বছর পার হয়েছে। গত বছর ১৯ মার্চ তিনি মারা যান। এর আগে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। সুস্থ থাকতেও তিনি ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। সকালে প্রাতর্ভ্রমণে যেতেন। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেও তাঁকে তেমন দেখা যেত না। অনেকটা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
এ বছর তাঁর মৃত্যু দিবসটিও নীরবে কেটে গেল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকায় কোনো খবর দেখেছি, মনে পড়ে না। মৃত্যুবার্ষিকীর খবর তখনই ছাপা হয়, যখন পরিবার থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। সাংবাদিকেরা নিজ থেকে করেন না।
যে মানুষটি দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, সেই মানুষটিকে এভাবে ভুলে যাওয়ার কারণ কী? একটা কারণ হতে পারে, তিনি কোনো দলের হয়ে কাজ করেননি। নিজের বিবেকবুদ্ধি দ্বারা যা সঠিক মনে করেছেন, তা-ই করেছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার সময় বিএনপির নেতৃত্ব যেমন তাঁর সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছে, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের শেষ দিকে আওয়ামী লীগও সদয় ছিল না। এরশাদকে জেলে নেওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি সব সময় তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ‘নিজস্ব লোক’ চায়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কারও নিজস্ব লোক হতে পারেননি।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। এরশাদ চেয়েছিলেন ক্ষমতায় থেকে তিনি আরেকটি নির্বাচন করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও পাঁচদলীয় বাম জোট তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে এরশাদ ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, কারফিউ জারি করেন। কিন্তু মানুষ তাঁর নির্দেশ মানেনি। তারা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আন্দোলনরত সব দলের অনুরোধে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি অবিচল আস্থাশীল সাহাবুদ্দীন আহমদ কখনোই সেই অধিকার প্রয়োগ করেননি। তিনি চেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হোক। তিনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনো বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বিএনপি নেতা ও তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথাবার্তা বললে তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর কড়া জবাব দেন।
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর পদাধিকারীরাও সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে আগের দায়িত্বে ফিরে যান। বিস্ময়কর হলো, সে সময় বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটুকু করেননি।
অনেকে সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতি পদের প্রতি যে তাঁর কোনোরকম মোহ বা আগ্রহ নেই, সেটাই প্রমাণ করলেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তা-ও বিশেষ পরিস্থিতিতে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, তিনি রাজি না হলে তাঁর বাড়ির সামনে দলের নেতা-কর্মীরা গিয়ে অনশন করবেন।
রাষ্ট্রপতি হয়ে তিনি প্রকৃতই চেয়েছিলেন সরকারি ও বিরোধী দল মিলেমিশে কাজ করুক। গণতন্ত্রের উন্নয়ন ঘটুক। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। তিনি মন্ত্রিসভার অনুমোদিত ভাষণই পড়ে শুনিয়েছেন। আবার লিখিত ভাষণের পর তিনি দুই পক্ষের সমঝোতার কথা বলতেন। সুষ্ঠুভাবে সংসদ পরিচালনার তাগিদ দিতেন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের পাঁচ বছর দুটো বিষয়ে সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রথমত, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। দ্বিতীয়ত, জননিরাপত্তা আইন নিয়ে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সাময়িক হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতিবাদ করলেন। পরে রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আর কথা বলেননি।
তাঁর পরামর্শেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছিল। ফলে বিচার প্রলম্বিত হলেও এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন জননিরাপত্তা আইনে প্রথমে সই করতে রাজি হননি। কিন্তু আইনটির সঙ্গে অর্থসংক্রান্ত বিষয় থাকায় দ্বিতীয়বার ফেরত দেওয়ার সুযোগ ছিল না। আইনটি পাস হয়ে যায়। সেই জননিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। যাঁরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, আইনটিকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতবিরোধ সম্পর্কে ২০১৬ সালে বিবিসিতে সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারি প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে চাওয়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। উনি নিজেকে যত দূর সম্ভব সরকারি বাধানিষেধের প্রভাব মুক্ত করে কিছু কথা বলেছিলেন, দেশের কল্যাণের জন্য। এই ধরনের কথা তিনি বলেছিলেন এবং কাজ তিনি করেছিলেন, তাতে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা রুষ্টই হয়েছিল।’
আমরা এমন সমাজ করেছি, যেখানে সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখা হয়। দলের বাইরে সবকিছু শত্রু মনে হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদ এ দেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
গোল বাঁধে সরকারের শেষ সময়ে ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দলের নেতারা অন্যায়ভাবে এর দায় চাপালেন সাহাবুদ্দীন আহমদের ওপর। আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানিয়েছিল। তিনি রাজি হননি।
একটি কারণ সাংবাদিক সমাজ তাঁর কাছে চিরঋণী। বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্রসংক্রান্ত ধারাটি তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েই বাতিল করে দেন। এই ধারায় ছিল সরকার মনে করলে অনাগত সময়ের জন্য কোনো পত্রিকা বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু যে পত্রিকা প্রকাশিতই হয়নি, সেই পত্রিকায় রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কী লেখা হবে, সরকার আগে থেকে সেটি কী করে মালুম করে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সেদিন আইনটি বাতিল না করলে পরবর্তীকালে কোনো সরকার করত কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আগে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কালাকানুন বাতিলের জন্য জোর আওয়াজ তুললেও ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে যায়। আমরা এমন সমাজ করেছি, যেখানে সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখা হয়। দলের বাইরে সবকিছু শত্রু মনে হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদ এ দেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আমাদের ক্ষমা করুন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]