একজন মাহফুজ সাদিকের অনন্তযাত্রা ও জীবনের মানে

মাহফুজ সাদিক

২৯ ডিসেম্বর ২০২৩। শীতের সকালে খবরটা যখন এল প্রথমবার শুনে কেউই বিশ্বাস করেনি। বন্ধের দিনের সেই সকালটাতে দেশে-বিদেশে যারাই খবরটা শুনেছিলেন, ভেবেছিলেন ভুল শুনছেন। তবে বাস্তবতা হলো বারবার প্রশ্ন করেও খবরটাকে ভুল প্রমাণ করা যায়নি, খবরটা মিথ্যা হয়নি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল, বন্ধুবৎসল, আড্ডাবাজ মাহফুজ সাদিক হৃদ্‌যন্ত্র বিকল হয়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সে, ওই সকালটাতে অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। মাহফুজ সাদিক যাদের ভালোবাসতেন, তাঁকে যাঁরা ভালোবাসতেন তাঁরা এই এক বছরেও তাঁর শূন্যতায় অভ্যস্ত হতে পারেননি।

চাকরিসূত্রে মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার মাত্র ২ বছর ৪ মাসের চেনাজানা। এত অল্প সময়ের পেশাগত পরিচিত একজন মানুষের মৃত্যু যা শিখিয়েছে, জীবনও তা শেখাতে পারেনি।

আমাদের সমাজে সফলতার যে মাপকাঠি প্রচলিত, সে অনুযায়ী মাহফুজ সাদিকের ঝকঝকে ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্কে বিশ্বমঞ্চের স্বীকৃতি, বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, বিবিসি ওয়ার্ল্ডের লন্ডন অফিসে ১৪ বছর চাকরি, তারপর নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে কম বয়সী বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন—এমন আরো অসংখ্য অর্জন জমেছিল তাঁর ঝুলিতে।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষাতেই অসাধারণ উপস্থাপনাও করতেন। তাঁর ভরাট কণ্ঠে প্রাণ পেত যেকোনো উপস্থাপন। কী দারুণ দক্ষতা, সক্ষমতা! অবশ্য নিজেকে গল্প কথক বা স্টোরিটেলার হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।

৩৬৬দিন পার হয়েছে। মাহফুজ ভাইকে নিয়ে গত এক বছরে তাঁর পরিচিত-অল্প পরিচিত যত মানুষ তাঁর সম্পর্কে যা বলেছেন বা লিখেছেন তার সবটাই মানবিক মাহফুজ সাদিককে নিয়ে। তার পেশাগত অর্জনকে ছাপিয়ে, মানুষ হিসেবে তাঁর গুণাবলির আলোর ঝলক ঠিকরে পড়েছে প্রতিটি স্মৃতি কথায়। মাহফুজ ভাইয়ের মৃত্যু, জীবনে মানবিক হয়ে ওঠার গুরুত্ব কত বেশি সেই বোধকে আরো বেশি পাকাপোক্ত করে দিয়ে গেছে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খুশি হওয়ার, বেদনাক্রান্ত হওয়ার, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা কমতে থাকে। তবে মাহফুজ ভাই ছিলেন এ ব্যাপারে ভীষণ ব্যতিক্রম। তাঁর সন্তান ঈশানকে রাস্তায় ফুচকা খাওয়ানো, তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোথায় ভালো কয়েকটা লাইন লেখা হওয়া, একটা ভালো ছবি সংগ্রহ করা বা লেটকা খিচুড়ির সঙ্গে ভুনা মাংসের ভুঁড়ি ভোজ—সবকিছুতেই চরম আনন্দ করতে পারতেন মাহফুজ ভাই। কেবল আনন্দে! মাহফুজ ভাইয়ের বেদনার তীব্রতার পুরোটাই তাঁর কাছের মানুষগুলোকে ছুঁয়ে যেত। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে আনন্দিত হওয়া, বেদনাক্রান্ত হওয়া, বিস্মিত হওয়া আর তার বহিঃপ্রকাশে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন শিশু। কজন পারে এমন শিশুত্ব, সজীবতা, নির্মলতা ধরে রাখতে!

যেকোনো মানুষকে আপন করে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মাহফুজ ভাইয়ের। তাঁর কথার উষ্ণতা খুব সহজেই ছুঁয়ে যেত অন্য সবাইকে। কারো সঙ্গে হয়তো একবারই দেখা হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে এমন ভাবে আলাপ করতেন যে ওই মানুষটার মনে হবে একজন আপন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। মাহফুজ ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর জন্য এমন অনেক বেদনার্ত হৃদয়ের আর্তনাদের আমি অনুভব করতে পেরেছি। তাঁর মতো এমন করে মানুষকে আপন করে নিতে পারাটা বর্তমান সময়ে এসে খুবই বিরল।

আর আড্ডাবাজ মাহফুজ ভাইয়ের খ্যাতি তো দেশে-বিদেশেই। প্রাণখুলে আড্ডা দেয়া কাকে বলে তা মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দেয়া সকলেই জানে। আড্ডা জমিয়ে রাখারা, আড্ডার প্রাণবিন্দু হয়ে ওঠার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। মাহফুজ ভাইয়ের জানা-পড়া ছিল ভিন্ন রকমের। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি সব বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর, ফলে সব আড্ডাতেই তিনি হয়ে উঠতেন মধ্যমণি।

দেশের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল তাঁর। মাটির টানে দেশে ফিরেছিলেন লন্ডনের সাজানো-গোছানো জীবন ছেড়ে। দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। বড় অসময়ে থেমে গেল স্বপ্নটা।

সাদা-কালো, লম্বা-বেটে, ধনী-গরিব, মেধাবী-বোকা, সামাজিক অবস্থান সব ছাপিয়ে মানুষকে মানুষের মতো গুরুত্ব দেওয়ার একটা অসীম ক্ষমতা ছিল মাহফুজ ভাইয়ের। সাম্যবাদ নিয়ে অনেকেই বলেন। কিন্তু তিনি সত্যিকারের সাম্যবাদিতার চর্চা করতেন। তাঁর জীবনসঙ্গী মালিহা ভাবির প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতেন সব সময়, স্ত্রীকে এই অগাধ সম্মান করাটাও আমাকে বরাবর মুগ্ধ করত।

মাহফুজ ভাইয়ের অফিস সহকারীর দায়িত্ব পালন করতেন সাগর। সম্প্রতি সাগর যমজ কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন। মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর ছিল এক অনন্য সম্পর্ক। সাগর তার দুই কন্যার নাম রেখেছেন মাহফুজা ইসলাম এবং সাদিকা ইসলাম। সমবয়সী, সমসামাজিক অবস্থান এমন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ভালোবাসার, আস্থার সম্পর্ক তবু তৈরি হয়ে যায়, করা যায়, কিন্তু অধীনস্থ অফিস সহকারীর সঙ্গে এমন অনন্য সম্পর্ক তৈরি করতে পারা সহজ নয়।

তবে মাহফুজ ভাই তো এমনই ছিলেন, মানুষের সঙ্গে সম্পর্কই ছিল তাঁর জীবনের মূলধন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ককে। কেবল সম্পর্ক তৈরিই নয় সম্পর্ককে তার মতো করে লালন করা, রক্ষা করার মানুষও এখন হাতে গোনা। মৃত্যুর পরও এই অনন্য গুণই তাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। যখন দুনিয়াতে থাকবে না তখন সাগরের মতো এমন করে কেউ ভালোবাসা, সম্মান জানাচ্ছে এর চেয়ে বড় পাওয়া মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে?

প্যাট্রিয়ট, প্যাশনেট, অনেস্ট, এনথুজিয়াস্টিক, এনার্জেটিক, ইমোশনাল, অ্যাসপ্রিয়েশনাল, হিউমেরাস, স্টোরিটেলার—এমন অসংখ্য বিশেষণে বিশেষায়িত করে মাহফুজ সাদিকের গল্পগুলো বলে চলেছেন তার প্রিয়জনেরা। এমন করেই বলে চলবেন আরো বহুদিন, বহুকাল। প্রাণবন্ত, ভুবন-ভোলানো, আন্তরিকতাপূর্ণ, হৃদ্যতায় ভরা মাহফুজ সাদিককে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?

প্রত্যেককে তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে উদ্বুদ্ধ করা, আশপাশের মানুষগুলোর ছোট থেকে ছোট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের আন্দোলিত করা, নানারকম ঘটনা ঘটিয়ে সারপ্রাইজ দিয়ে প্রিয়জনের বিশেষ মুহূর্তকে আরো বিশেষ করে তোলা, প্রাণ খুলে আড্ডা দেয়া, সব কাজই অপার আগ্রহ নিয়ে করা,দেশ-বিদেশের সব বিষয় নখদর্পণে রাখা, আগ্রহ নিয়ে নতুনকে শেখা, জমিয়ে-কবজি ডুবিয়ে তৃপ্তি নিয়ে কাচ্চি খাওয়া-প্রতিটি মুহূর্তকে উদ্‌যাপন করা মাহফুজ ভাইয়ের মতো করে খুব কম মানুষই পারে। একটা ধার করা লাইন দিয়ে বলি, প্রতি মুহূর্ত বেঁচে ছিলেন মাহফুজ সাদিক, প্রতিদিন বেঁচে ছিলেন।

  • রুখসানা মিলি সহকর্মী