নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা: আজ জনসেবায় ৬৭ মিনিট কাটানোর দিন

ধূসর কোর্ট ও বজ্রমুষ্ঠি ছিল নেলসন ম্যান্ডেলা ব্যক্তিত্বের প্রতীক।ছবি : এএফপি

রবেন আইল্যান্ডে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০০১ সালে। সেবারই প্রথম কেপটাউন যাই। হোটেলে ব্যাগ রেখেই ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। আমার মনে হচ্ছিল, পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ কাজের ব্যস্ততায় যদি সেখানে যেতে না পারি তাহলে জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই গবেষণার কাজ শুরুর আগেই দেখতে চেয়েছিলাম বন্দিজীবনের আঠারোটি বছর কোথায় ছিলেন ম্যান্ডেলা।

একজন সাবেক রাজবন্দী গাইড হিসেবে দ্বীপটি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। যে ছোট্ট ঘরটিতে ম্যান্ডেলাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তার কথা এখন পুরো পৃথিবী জানে। তবু সামনে দাঁড়িয়ে ঘরটি দেখার এবং সেখানে আকাশের চেয়েও উঁচু একটি মানুষকে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল সে কথা ভাবার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

ম্যান্ডেলাই শিখিয়েছেন, আমরা আমাদের বেদনার চেয়ে বড় হয়ে ওঠার শক্তি রাখি। ১৯৯০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে তিক্ত দ্বন্দ্বের পরিবর্তে তিনি বিরোধ মীমাংসার পথ বেছে নিয়েছেন; অতীতের ক্ষত নিয়ে বসবাস করতে অস্বীকার করেছেন।

পৃথিবীর অনেক দেশে নেতারা যখন কেবল জাতির জন্য ক্ষতিকর অতীত চর্চা করে যাচ্ছেন তখন ম্যান্ডেলা দেখিয়েছেন অতীতকে স্বীকার করেও কীভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। শান্তি পুরস্কার প্রদানের সময় নোবেল কমিটি বলেছে, সহিংসতার পৃথিবীতে ম্যান্ডেলা মানবতার আদর্শ সমুন্নত রেখেছেন। তিনি পৃথিবীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে তিক্ততা ও সহিংসতার চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেল্ফ’ বইটি ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার, রোজনামচা, অপ্রকাশিত আত্মজীবনীর এক সুসম্পাদিত সংকলন। বইটিতে তিনি ওয়াল্টার সিসুলু আর অলিভার টাম্বোর মতো বন্ধু ও নেতাদের অবদানের কথা বারবার সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন, বলেছেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ‘সম্মিলিত নেতৃত্ব’ দর্শনের কথা।

শ্বেতাঙ্গ শাসকদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন অসম্ভব ভদ্রতা ও সৌজন্য সহকারে। বইটি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাষ্ট্রনায়কোচিত সততা, সাহস, প্রজ্ঞা, বিনয়, ঔদার্য আর মানবিকতার এক অনন্য দলিল। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে সহিংসতা, অসৌজন্যমূলক আচরণ, সংকীর্ণতা যখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন ম্যান্ডেলার জীবন থেকে শিক্ষা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

বইটিতে কারাগারের ওয়ার্ডারদের কথা বারবার এসেছে। ওয়ার্ডাররা সাধারণত বন্দীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য নির্মম নির্যাতন চালাতেন। ম্যান্ডেলা ওয়ার্ডারদের সঙ্গে কথা বলতেন, জানতে চাইতেন তাঁদের জীবনের কাহিনি। তিনি একজন ওয়ার্ডারের গল্প বলেছেন। লোকটা এতিমখানায় বড় হয়েছিলেন। এতিমখানায় থাকা তাঁর ও অন্য শিশুদের বড় কষ্টের কারণ ছিল। সেখানে থাকার বিষয়টি তাঁরা কখনো মেনে নিতে পারেননি। ফলে টেবিলে বসে একসঙ্গে খাওয়ার সময় কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতেন না।

ম্যান্ডেলার সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, কতটা মানবিক হলে কোনো মানুষ তাঁকে নির্যাতনকারী ব্যক্তির মানসিকতা তৈরির ইতিহাস আর জীবনের কষ্টটা এতখানি দরদ দিয়ে তুলে ধরতে পারেন!

নেলসন ম্যান্ডেলাকে আমি দুইবার স্বচক্ষে দেখেছি। মনে পড়ছে ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানের কথা। তিনি যখন ব্যাংককের ইমপ্যাক্ট এরিনার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন তখন সম্মেলনের প্রায় ২০ হাজার অংশগ্রহণকারী দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁকে সম্মান ও ভালোবাসা জানিয়েছিলেন। হাততালি থামছিলই না; তিনিও মঞ্চ ছাড়তে পারছিলেন না। মুখে সেই ভুবনজয়ী হাসি। দ্বিতীয়বার দেখেছিলাম কেপটাউনে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস স্কলারশিপের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেপটাউনে সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন হয়েছিল। ম্যান্ডেলা সেখানে এক নৈশভোজে বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। তাঁর বক্তব্য শুনতে শুনতে আমি বুঝেছিলাম, পিনপতন নীরবতার প্রকৃত মানে কী।

ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সব বর্ণের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন আপন কর্ম দিয়ে। বর্ণবাদমুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকা যখন রাগবি (যে খেলাটি তার আগ পর্যন্ত শুধুই সাদা মানুষের খেলা ছিল) বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলল, তিনি স্প্রিংবকদের জার্সি গায়ে মাঠে উপস্থিত হলেন। জয় করলেন শ্বেতাঙ্গদের মনও। এই হলেন একজন প্রকৃত নেতা, যিনি চরম বিভক্তির সময়ও জাতিকে একতাবদ্ধ করতে জানেন। বন্ধুদের কাছে শুনেছি, যাঁরা তাঁকে ২৭ বছর কারাবন্দী করে রেখেছিলেন তাঁদের তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন দেখে তাঁরাও ব্যক্তিগত জীবনে ক্ষমাশীল হয়েছেন।

ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পরেও। এইডস–বিষয়ক একটি পোস্টারে তাঁর ছবির নিচে লেখা ছিল ‘গুড লিডার্স লিড’ অর্থাৎ ‘ভালো নেতারা নেতৃত্ব দেন’।

ম্যান্ডেলার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে স্মরণ করে ২০০৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষিত হয়। এ দিনটি ব্যক্তি, সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানায় যাতে সবাই ম্যান্ডেলার মূল্যবোধ নিয়ে চিন্তা করে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়।

ম্যান্ডেলা অবসর নেওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এইডস মোকাবিলায় ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়। সমস্যাটি দীর্ঘদিন তারা স্বীকারই করেনি। এভাবে অপচয় হয়েছে মহামূল্যবান সময়। তখন সঠিক পদক্ষেপ নিলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমানো যেত। জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে ম্যান্ডেলা আবার এগিয়ে এলেন। জনসমক্ষে ঘোষণা করলেন, তাঁর এক সন্তানের মৃত্যুর কারণ এইডস। তাঁর ঘোষণা এই রোগে আক্রান্তরা যে সামাজিক কলঙ্কের শিকার হন, তা দূর করায় রাখল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, নেতার কাজ ‘নেতৃত্ব’ দেওয়া, বিভ্রান্তি তৈরি করা নয়। কিন্তু এর বিপরীতটাই কি আমরা আজকাল হরহামেশা দেখছি না?

নেলসন ম্যান্ডেলা সর্বোপরি একজন রাজনৈতিক নেতা; তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিহাস করবে। তবে তিনি শান্তি ও সহিষ্ণুতার যে দৃষ্টান্ত নিজের জীবন দিয়ে স্থাপন করেছেন, তা অতুলনীয়। যখন পৃথিবীতে মানুষকে ক্রমান্বয়ে সংকীর্ণ পরিচয়ের গণ্ডিতে বন্দী করার চেষ্টা চলছে তখন তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে বৈচিত্র্যই মানুষের সৌন্দর্য আর তাই তো দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ–নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

নেলসন ম্যান্ডেলা এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করা আদর্শসমূহ, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন আর একান্ত আশাগুলো হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত হবে না। তবে সেটা তেমন কোনো বড় বিষয় নয়। আমরা যদি আমাদের সময়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি এবং মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাই, তাহলে সেটাই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও চমৎকার অর্জন।’

ম্যান্ডেলার ক্ষমা, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, প্রজ্ঞা আর মানবিকতার কথা ভাবলে এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টির জন্য ‘এই আকালেও স্বপ্ন’ দেখা যায়; নিজ কালে নিজ দায়িত্ব পালন করার জন্য হওয়া যায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ম্যান্ডেলার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে স্মরণ করে ২০০৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষিত হয়। এ দিনটি ব্যক্তি, সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানায় যাতে সবাই ম্যান্ডেলার মূল্যবোধ নিয়ে চিন্তা করে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস মানুষকে এই দিনে জনসেবায় ৬৭ মিনিট ব্যয় করতে উৎসাহিত করে, যা প্রতীকীভাবে ম্যান্ডেলার ৬৭ বছরের জনসেবার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। কোনো উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া, রক্তদান, গাছ লাগানো, অসুস্থ কাউকে দেখতে যাওয়া, শিশুদের বই পড়ে শোনানো বা কোনো কাজ যা অন্যদের উপকারে আসবে তেমন যেকোনো কিছু এই দিনে করা যায়।

এবারের নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসে আপনি কী করবেন?

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী