আনিসুর রহমান স্যার অনেক কিছুই আমাদের দিয়ে অসীমের পানে চলে গেলেন। আমার দুঃখ, তিনি জীবিত থাকতে অনেকেই আমরা তাঁকে বুঝতে পারিনি। এখনো কয়জন তা জানেন ও বোঝেন, তা আমি জানি না। তিনি অন্তর থেকে চেয়েছিলেন, এ দেশের সাধারণ শ্রমজীবীরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের ভাগ্যটা নিজের হাতে নিক। নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বদলে দিক। তাঁর প্রিয় স্লোগান ছিল, ‘এসো আমরা পরস্পরকে শাণিত করি’।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় থাকাকালে বিশ্বব্যাপী যে উন্নয়ন কর্মসূচি তিনি পরিচালনা করতেন, সেটারই আফ্রিকান চ্যাপটার থেকে তিনি এ স্লোগান পেয়েছিলেন!
বিদ্যমান ধনতন্ত্রে ‘উগলালানা’ বা শ্রমজীবী জনগণের সেই পারস্পরিক সহযোগিতা তো সম্ভব হয়ইনি, আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রেও তা হয়নি। আনিসুর রহমান স্যার তা ভালোভাবেই জানতেন। আমরা যখন ১৯৯০ সালের সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় দিশাহারা, তখন তাঁর নতুন উন্নয়নদর্শন নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন আমাদের সামনে। জেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত পিপলস সেলফ ডেভেলপমেন্ট বইয়ে এই দর্শনের সন্ধান মিলবে।
বইটি আমাকে নতুন করে জগৎকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিল। তিনি মাও ও মার্ক্সের কিছু কিছু বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে তাঁদের মূল বক্তব্যটি আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ইম্যানসিপেশন ফর/ অব দ্য পিপল’ যথেষ্ট নয়, হতে হবে ‘ইম্যানসিপেশন বাই দ্য পিপল’। সেখানে কোনো ফাঁক থেকে গেলে প্রতিক্রিয়ার পুনরুত্থান হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে আনিসুর রহমান স্যার দেখতেন তখন? এ কথা এখনকার জন্য শিক্ষণীয়। তাই এটি খুবই সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। স্যারের একটি বই আছে—১৯৯৭ সালে গণপ্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। নাম যে আগুন জ্বলেছিল—মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এ বইয়ে স্যারের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র বা বিদেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে সেই সময় গ্রামবাংলার কোণে কোণে জনসাধারণ মাঠে-ময়দানে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সৃজনশীল অসংখ্য দেশগঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ বইয়ে সে রকম ১০ থেকে ১২টি উদ্যোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
আনিসুর রহমান স্যারের এই দর্শন আমাদের সমাজের ভদ্রলোক বা বিপ্লবী—কোনো মহলেই গৃহীত হয়নি। তিনি তখন প্রথম আলোর কিছু উৎসাহী চারণ সাংবাদিককে নিয়ে দীর্ঘদিন দেশের সর্বত্র ‘অন্য আলোর’ উদাহরণগুলো খুঁজে বের করেছেন।
প্রথম আলোয় কিছুদিন জনগণের সেসব সৃজনশীল উদ্যোগের কাহিনি প্রকাশিতও হয়েছিল। কিন্তু সেই মাইক্রো উদ্যোগগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তিনি তখন রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (আরআইবি) গঠন করেন। তিনি জনগণের কাছেই আবার ফিরে যান। তাঁদেরই বলেন, ‘আপনারা নিজেরাই গণগবেষণা করে আপনাদের সম্মিলিত সামষ্টিক মুক্তির পথটি খুঁজে বের করুন।’
এ কাজ যখন চলছিল, তখন একই সঙ্গে আনিসুর রহমান স্যার আরও গভীরভাবে রবীন্দ্র–অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। রবীন্দ্রসংগীতে তাঁর যে অসাধারণ গলা ছিল; চর্চাও তখন তিনি করেছিলেন। দুই বাংলাতেই তখন তাঁর গানের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ছিল। এ সময় একটি হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ডোরা রহমান স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে যান। এর পর থেকে স্যার একটু একটু করে কাজ কমিয়ে দেন।
২০১৫ সালে ডোরা ভাবির মৃত্যু হয়। সেই শোক স্যার পুরোপুরি কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর ছয় বছরের মধ্যে নিজে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বাক্শক্তি হারান। তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে তাঁকে হাসপাতালে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। খুব কর্কশভাবে উনি আমাকে ধমকাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি উৎফুল্ল হচ্ছিলাম এই ভেবে যে যাক, স্যার আবার কথা বলছেন। এর মাত্র কয়েক দিন পরই ৯১ বছর বয়সে স্যার আমাদের ছেড়ে গেলেন।
তখন ১৯৭৪ সাল। স্যার আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষে মাইক্রো ইকোনমিকস পড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্নপুরুষ। ক্লাসে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘আজ থেকে তোমাদের টিচার হচ্ছে বাংলার কৃষক। তোমাদের আমি পড়াব কৃষকের টেক্সট বই থেকে খোদ কৃষকের প্রোডাকশন ফাংশন।’ আমরা অর্ধশতাধিক ছাত্রছাত্রী হাঁ করে মুগ্ধ হয়ে তাঁর ক্লাস করেছি। প্রত্যেক শিক্ষার্থী এখনো দেখা হলে নির্দ্বিধায় বলে যে ওই ক্লাসে স্যার আমাদের মাথায় ‘মারজিনাল’ (প্রান্তিক) ধারণাটি এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে সারা জীবনে কেউই তা আর ভুলিনি!
মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে আনিসুর রহমান স্যার দেখতেন তখন? এ কথা এখনকার জন্য শিক্ষণীয়। তাই এটি খুবই সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। স্যারের একটি বই আছে—১৯৯৭ সালে গণপ্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। নাম যে আগুন জ্বলেছিল—মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এ বইয়ে স্যারের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র বা বিদেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে সেই সময় গ্রামবাংলার কোণে কোণে জনসাধারণ মাঠে-ময়দানে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সৃজনশীল অসংখ্য দেশগঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ বইয়ে সে রকম ১০ থেকে ১২টি উদ্যোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
তিনি বইয়ের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই দেশ আমার, এ হচ্ছে সেই-সব প্রাণীর কথা যারা বিশ্বে ও বাহ্য ব্যাপার সম্পর্কে পরাসক্ত। কিন্তু যেহেতু মানুষের যথার্থ স্বরূপ হচ্ছে তাঁর আত্মশক্তিসম্পন্ন অন্তর প্রকৃতিতে, এই জন্য যে দেশকে মানুষ আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে সৃষ্টি করে তোলে সেই দেশই তার স্বদেশ।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যে ও আহ্বানে, কালান্তর)
এরপর ভূমিকায় ‘দুটি কথা’ শিরোনামে স্যার নিজের কলমে লিখেছেন:
‘স্বাধীনতার পরে দেশের বহু স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও অগণিত দেশপ্রেমিক জনগণ ও তরুণ-ছাত্রসমাজ দেশকে “আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে” সৃষ্টি করে তুলবার যে অসংখ্য উদ্যোগ, সে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছিল, সে সমস্ত উদ্যোগ সম্বন্ধে যে তথ্যাবলি সংগ্রহ করা গেছে, সেগুলি একত্র করা হয়েছে এই সংকলনে। এই উদ্যোগগুলিই এ জাতির দেশ গড়বার কাজে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ক ঐতিহ্য, আজকের প্রজন্মেও জাতি পরিচয়ের একটি উজ্জ্বল পাতা। মুক্তিযুদ্ধেও চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।’
সেই স্বনির্ভর ও সামষ্টিক চেতনা কি আমরা আবার কোনো দিন পুনরুদ্ধার করতে পারব? স্যারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই বলতে চাই, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
● এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক