একজন দেশপ্রেমিক ও মৃদুভাষী বন্ধুর প্রস্থান

বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, ২ মে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মোহাম্মদ আলী ১৯৮০ সালে হাইকোর্টে ও ১৯৮৫ সাল থেকে আপিল বিভাগে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন ও ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বাবা এম এইচ খন্দকার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল।

মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭০ সালে। সে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ও আমি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। আমাদের বন্ধুত্ব ও পরিচয়ের ব্যাপ্তিকাল ৫০ বছরের বেশি। আমরা তাকে কেটি বলে ডাকতাম।

প্রথম সাক্ষাতে, যে কারণে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো, সে ছিল স্বল্প ও মৃদুভাষী। আমাদের প্রজন্মের অন্য সব বাবার মতো মোহাম্মদ আলীর বাবাও ছিলেন রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। মোহাম্মদ আলীদের দোতলা বাসায় ঢুকতেই ছিল তাঁর চেম্বার। তিনি চেম্বারে থাকলে আমরা মৃদু পায়ে তাঁর পাশ দিয়ে মোহাম্মদ আলীর রুমে চলে যেতাম। রাশভারী হলেও আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ।

পরবর্তী সময় ১৯৭৬ সালে, সিভিল সার্ভিসে যোগদানের প্রাক্কালে বিজ্ঞাপনে বর্ণিত আমাদের সার্ভিস প্রোফাইল পরিবর্তন করা হয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আমাদের এটা ‘চুক্তি ভঙ্গ করা হয়েছে’ অভিহিত করে আমাদের মামলা করার পরামর্শ দেন। আমাদের কারও হাতে তখন মামলা করার মতো টাকাপয়সা ছিল না। তাই আমরা মামলা করার আগে মোহাম্মদ আলীর বাবার পরামর্শ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই।

আমরা কয়েকজন ভয়ে ভয়ে তাঁদের বাসায় যাই। মোহাম্মদ আলীর বাবা আমাদের কথা শুনে বললেন, ‘ইউ হ্যাভ নো কেইস’। আমরা ‘চুক্তি ভঙ্গ করা হয়েছে’ এ কথা তুললে তিনি বলেন, ‘চাকরির বিজ্ঞাপন কোনো চুক্তি নয়। তারপর বাংলাদেশের সংবিধান খুলে দেখালেন যে সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে সিভিল সার্ভিস বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’

আমরা তাঁর পরামর্শে মামলা করা থেকে বিরত হই। মোহাম্মদ আলীর পেশাগত উত্তরাধিকারের বিষয়টি বোঝাতে প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হলো। আইন ছিল তার অস্থিমজ্জায়।

তাই অর্থনীতি পড়েও সে যখন আইন পেশায় যোগ দিল, আমরা তখন অবাক হইনি। তবে আমি আশা করেছিলাম, সে বিচারপতি হবে। একদিন তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। বললাম, ‘তুমি যখন আইন পেশা বেছে নিলেই, বিচারপতি হলে না কেন? একদিন প্রধান বিচারপতি হতে, আমরা গর্ব করতাম।’

তার সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, ‘আমার “বেঞ্চ (বিচারকদের আসন)” থেকে “বার (আইনজীবীদের আসন)” বেশি ভালো লাগে।’

তবে একটা বিষয়ে অবাক হয়েছিলাম। তা হলো মোহাম্মদ আলীর দলীয় রাজনীতিতে যোগদান নিয়ে। তাকে ছাত্রাবস্থায় কোনো ছাত্রসংগঠন, মিটিং বা মিছিলে দেখিনি। তাই ফৌজদারহাটের বিধিবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিবিমুখ মোহাম্মদ আলীকে এ বিষয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করি।

সে তার দেশপ্রেম ও দূরদৃষ্টি থেকে আমাকে বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সেটা রক্ষা করতে ও অক্ষুণ্ন রাখতে সে দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি হয়েছিলেন।

এখানে তার ব্যক্তিত্বের অভিমানী দিকটি তুলে ধরতে একটি একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা না করলেই নয়। ২০১০ সালে আমাদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি মোহাম্মদ আলীর পরিবারকে দাওয়াত করতে ভুলে যাই। অথচ তার বাসার কাছেই আমার ভাই-বোনদের বাসায় এ প্রসঙ্গে কয়েকবার গেছি।

আমার আরেক বন্ধু বিয়ের দিন মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ফাওজুলের মেয়ের বিয়েতে যাচ্ছ তো?’ মোহাম্মদ আলী বলে, ‘ফাওজুল তো আমাদের দাওয়াত করেনি।’ আমার বন্ধুটি বলে, ‘তোমাদের দাওয়াত করে নাই এটা হতে পারে না, চলো যাই।’ মোহাম্মদ আলী বলে, ‘না, তোমাদের দাওয়াত করেছে, তোমরা যাও।’

পরে আমি বিষয়টি জেনে সংকুচিত হই এবং অপরাধ বোধে ভুগি। এখন বুঝতে পারি, আমার স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার বিষয়টি এক যুগের বেশি সময় আগেই শুরু হয়েছে! না হলে আমার মেয়ের বিয়ের আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা থেকে মোহাম্মদ আলীর পরিবার বাদ যায় কীভাবে?

পরে করোনার সময় আমার ছেলের বিয়ে হলে অনুষ্ঠান না করে মোহাম্মদ আলীসহ সীমিতসংখ্যক আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাসায় খাবার পাঠাই। একই ভুল তো আর দুবার করা যায় না!

এবার একটি লঘু প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। আমাদের এক প্রবাসী বন্ধু, তার ছেলের বিয়েতে আমাদের দাওয়াত করে। বিয়ের অনুষ্ঠানস্থল ছিল শাহীন হল, শাহীন কলেজের পাশে। মোহাম্মদ আলী ও আমাদের আরেক বন্ধু লিয়াকত (ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার) ভুল করে বিমানবাহিনী আবাসিক এলাকায় একটা বিয়েতে ঢুকে পড়ে। দু-দুজন ভিআইপি অতিথি পেয়ে বর ও কনেপক্ষ তাঁদের সমাদরে বসিয়ে খাইয়ে দেয়।

খাওয়া শেষে লিয়াকত আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই কই?’ আমি বলি, ‘আমরা বিয়েতে, শাহীন হলে। তোরা কখন আসবি?’ লিয়াকত আমাকে বলে সে ও মোহাম্মদ আলী ভুল অনুষ্ঠানে উপহার দিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরেছে!

আমি পরে মোহাম্মদ আলীকে পরিহাস করে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভুল জায়গায় গেছ বুঝলাম, কিন্তু উঠে এলে না কেন?’ মোহাম্মদ আলী বলে, ‘তোমাদের কাউকে না দেখে আমার ডাউট হইছিল। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করে উঠে আসতে পারলাম না।’ সত্যিই দেশ ও দেশের মানুষকে অনেক ভালোবাসত মোহাম্মদ আলী।

পরিশেষে আমি মোহাম্মদ আলীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। মাটির মানুষ ফারজানা ভাবি, আইনজীবী ছেলে রিয়াজ ও মেয়ে রাদিয়াকে জানাতে চাই, ‘আমরা, কেটির বন্ধুরা, তোমাদের পরিবারের পাশে আছি এবং থাকব।’

বিদায় বন্ধু, বিদায়! আল্লাহ তোমাকে জান্নাতবাসী করুন। আমরাও তোমার অনুগামী হব।

● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব