বাহাত্তরের ‘সরব কণ্ঠ’ বীর উত্তম জিয়াউদ্দিন, নীরবেই চলে গেলেন

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)ছবি: সংগৃহীত

৫ আগস্ট, মঙ্গলবার, ঢাকার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টির পানিতে ভিজছিল রাজপথ। গত বছর এই দিনেই ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এই দিনকে ‘জুলাই অভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

এই দিনে প্রায় সব টেলিভিশনের পর্দায় গত বছর এই সময়ে চলা হাসিনা সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নৃশংসতার ছবি ও বর্ণনা ভেসে উঠছিল, যা দেখে চোখ ভিজছিল বারবার।

বিকেলে একটি দুঃসংবাদে সেই চোখের পানি বৃষ্টির মতোই নেমেছে সম্মুখ রণাঙ্গনের একদল লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার চোখে। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম) (৮৩) ৫ আগস্ট ২০২৫ বিকেলে সবাইকে ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম থেকে শিয়ালকোট হয়ে জীবন বাজি রেখে ভারত হয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করেছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন, যিনি সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, মেজর তাহের, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ মেজর মঞ্জুর এবং একজন বাঙালি সৈনিক। উল্লেখ্য, তাঁদের মধ্যে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে তাহেরকে কর্নেল পদে থাকাকালে কথিত অভ্যুত্থানচেষ্টার দায়ে সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর মঞ্জুর মেজর জেনারেল অবস্থায় প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটান এবং পরবর্তী সময়ে জিয়াপন্থী একদল সেনার হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

সদ্য প্রয়াত জিয়াউদ্দিনসহ এই দুঃসাহসী দল ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই রাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে জীবন বাজি রেখে কাশ্মীর অঞ্চলে পাকিস্তান–ভারত সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। মেজর মঞ্জুরের বাচ্চাদের ঘুমের ওষুধ দিয়ে প্রায় অচেতন করে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যান জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। ‌

কাশ্মীর সীমান্তে মোতায়েন দুর্ধর্ষ রেঞ্জারস, কমান্ডো ও অন্য সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে পাহাড়, নিচু খাদ, জঙ্গল ও ফসলের মাঠে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, আবার কখনো হাঁটুতে ভর করে পাড়ি দেন দীর্ঘ এক বিপৎসংকুল দুর্গম পথ। সারা রাত জীবনমৃত্যুর দোলাচলে দুলে এবং দুবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভোরের প্রথম আলোতে ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করেন এই জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদেরই একজন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী তথা পরবর্তী সময়ে কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতীক) এই দুঃসাহসিক যাত্রা ও পরবর্তী সময়ে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে’ শীর্ষক একটি বই লেখেন।

জিয়াউদ্দিন তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তাঁর মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা এমন চুক্তিকে দেশের জন্য ক্ষতিকর ও স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন ইমেজ, সার্বভৌম ক্ষমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক মতানুসারীদের আকাশচুম্বী ক্ষমতার কারণে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নীরব, নিথর। ‌ কিন্তু গর্জে উঠেছিলেন একজন, তিনিই জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন গণমাধ্যমকে।

আমার সৌভাগ্য, কিছু বিচ্ছিন্ন নোট সম্পাদনা করে এমন একটি বই রচনার সঙ্গে আমি সংযুক্ত ছিলাম। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রথমা প্রকাশন বইটি প্রকাশ করে। তখন কর্নেল পাটোয়ারীর মুখে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়ার বীরত্বগাথা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য উপাখ্যান জানতে পেরেছিলাম। আবেগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে সামরিক হাসপাতালে অসুস্থ বীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াকে দেখতেও গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে। ‌

পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম ছেড়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন ও তাঁর দল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সহায়তায় পরবর্তী সময়ে তাঁদের নেওয়া হয় দিল্লিতে। দিল্লির ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা, বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা সমরবিদ ও গোয়েন্দারা, তখন ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) ভূখণ্ডকে শত্রুমুক্ত করতে চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক তখন জিয়া, মঞ্জুর, তাহের ও পাটোয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা ও তাদের গোপনীয় সব পরিকল্পনার তথ্য জানিয়ে যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ–পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ‌

দিল্লির পর্ব শেষে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী সঙ্গে দেখা করেন। ওসমানীর নির্দেশেই মেজর জিয়াউদ্দিন সিলেট বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ সীমান্তে যুদ্ধরত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। আর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির অধিনায়ক ও উপ–অধিনায়কের দায়িত্ব পান ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী। ক্যাপ্টেন হাফেজ (বিএনপি নেতা), লেফটেন্যান্ট মাহবুব, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত প্রমুখ আগে থেকেই এই সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন। তাঁদের চিকিৎসক ছিলেন ক্যাপ্টেন মুজিব, যিনি পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। লেফটেন্যান্ট আকাশসহ আরও কিছু সাহসী অফিসার কর্নেল জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে মরণপণ লড়াই করেছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)
ছবি: সংগৃহীত

মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্ব গ্রহণের আগে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জুলাই মাসের ধনুয়া-কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এ যুদ্ধে ‘সিনিয়র টাইগার্স’ নামে অধিক পরিচিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ জন অফিসারসহ ৩৩ জন বিভিন্ন পদবির সেনা শাহাদাতবরণ করেন। এ ছাড়া ২ জন অফিসারসহ ৬৬ জন সেনা গুরুতর আহত হন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সেনাদলের যুদ্ধের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সহযোদ্ধাদের হারিয়ে বাকি সেনারা ভয় ও হতাশার শিকার হন।

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, অনুপ্রেরণা ও সম্মুখে থেকে জীবন বাজি রাখা নেতৃত্ব দিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিন এই সেনাদের নিয়েই গড়ে তোলেন পাকিস্তানিদের ঘুম হারাম করা আজরাইল বাহিনী ‘সিনিয়র টাইগার্স’। রাতের অন্ধকার ভেদ করে জিয়াউদ্দিন ও তাঁর সেনারা গগনবিদারী ‘টাইগার’ স্লোগান তুলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর ওপর।

এভাবেই জিয়াউদ্দিন নেতৃত্বে একের পর এক সফল যুদ্ধ চালিয়ে যায় সিনিয়র টাইগার্সরূপী প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। একে একে শত্রুমুক্ত হয় ধলই চা–বাগান, রাজঘাট চা–বাগান, শিলচর, আটগ্রাম, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট। সবশেষে শত্রুমুক্ত করে সিলেটে বিজয়পতাকা ওড়ান সদ্য প্রয়াত সেদিনের মেজর জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম)।

স্বাধীনতার পর ঢাকা সেনানিবাসের স্থাপিত ‘ব্যাটেল স্কুল’ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জিয়াউদ্দিনকে। এই স্কুলেই স্বাধীন বাংলাদেশের নবীন অফিসারদের প্রশিক্ষণের সূত্রপাত ঘটে।

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি’ শিরোনামে ২৫ বছরের মেয়াদি একটি চুক্তি করেন। অনেকের কাছেই এটি ছিল একটি গোলামি চুক্তি, যা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়।

জিয়াউদ্দিন তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তাঁর মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা এমন চুক্তিকে দেশের জন্য ক্ষতিকর ও স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন ইমেজ, সার্বভৌম ক্ষমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক মতানুসারীদের আকাশচুম্বী ক্ষমতার কারণে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নীরব, নিথর। ‌ কিন্তু গর্জে উঠেছিলেন একজন, তিনিই জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন গণমাধ্যমকে।

১৯৭২ সালের আগস্টে তৎকালীন সাপ্তাহিক ইংরেজি সাময়িকী হলিডেতে জিয়াউদ্দিন ‘লুকানো মূল্য’ (হিডেন প্রাইজ) শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। ‌বিভিন্ন সূত্রমতে এই নিবন্ধে জিয়াউদ্দিন তাঁর দৃষ্টিতে অবমাননাকর চুক্তিটি বাতিল করার দাবি জানান; তারপরও শেখ মুজিবের প্রতি ইঙ্গিত করে লেখেন, ‘আমরা তাকে (শেখ মুজিবুর রহমানকে) ছাড়াই লড়াই করেছি এবং জয়লাভ করেছি। প্রয়োজনে তাকে ছাড়াই আবার যুদ্ধ করব।’

ওই লেখা প্রকাশের সময় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি জিয়াউদ্দিনকে ডেকে পাঠান এবং ক্ষমা চাইতে বলেন। বীর সেনা জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) এমন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

একবুক অভিমান নিয়ে জিয়াউদ্দিন রাজধানী ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। অনেকেই মনে করেন, এ সময় তিনি সিরাজ শিকদার কিংবা অন্য কোনো বামপন্থী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম শহরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তাঁর শেষ জীবন নীরবেই কাটে চট্টগ্রামের নিজ বাড়িতে।

৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ফ্যাসিস্টকন্যা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর এক বছর পূর্তির দিনে পৃথিবী ছেড়েই নীরবে চলে গেলেন বাহাত্তরের সরব কণ্ঠ বীর উত্তম জিয়াউদ্দিন। ৭ আগস্ট দুই দফা জানাজা শেষে যথাযথ মর্যাদায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মরণোত্তর সালাম ও শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধের এই প্রবাদপুরুষকে।

  • নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, গবেষক ও বিশ্লেষক। ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব