শুভাগত স্যারের প্রস্থান সংবাদটি আকস্মিক এক আঘাতের মতোই মনকে নাড়া দিল। স্যার আর আমাদের মাঝে নেই! গত বছর বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায় স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথা হয়েছিল। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন স্যারকে কীভাবে পেয়েছি, মনের ওপর তার যে একটা ছাপ থেকে গিয়েছিল—এ রকম কথাও হয়েছে সেদিন। তিনি হেসেছেন। এ বছর একাডেমিতে স্যারকে খুঁজেছি। পাইনি। মনের মধ্যে খুবই বোধ হচ্ছিল, তিনি বুঝি অসুস্থ হয়ে পড়লেন!
গত বছর বলেছিলেন, মাত্রই রক্তের কর্কট রোগ থেকে সেরে উঠেছেন তিনি, এখন ভালো আছেন। তার পর থেকে উদ্যোগী এই মানুষটি নবতর কাজে যুক্ত হয়েছেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের বেদনা লাঘবের জন্য প্যালিয়েটিভ সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন স্যার। মনের মধ্যে খুবই বোধ হচ্ছিল, স্যারকে কি একটা ফোন করব? কখনো করিনি তো, তাই বোধ হয় আর করা হলো না।
হঠাৎ কখনো দেখা হলেই যা কথা হয়েছে। অবাকই হয়েছিলাম যখন গত বছর বলেছিলেন, কর্কট রোগে অনেক দিন ভুগেছেন তিনি। ‘স্যার আপনিও?’ আগাগোড়া একজন ডিসিপ্লিনড মানুষ, খাদ্য-পথ্য বিষয়ে সজাগ-সচেতন মানুষটিও যে এ রকম এক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, সেই ধারণা থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল অবচেতনে। আসলে খাদ্য-পথ্য কী সব যে খাচ্ছি আমরা, খেতে বাধ্য হচ্ছি! এ সত্যিই ভাবনার বিষয়। এত সব ভেজাল চারপাশে, ফুড সিকিউরিটি বলতে কিছু নেই!
স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই! তাঁর কর্ম এবং চেতনাবোধ নিয়ে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি, তবে তা হবে প্রফেসর ডা. শুভাগত চৌধুরীর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন।
স্যারকে কীভাবে চিনি? কীভাবে তিনি আমাদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন, সে কথাই বলি এবার। সালটা ১৯৮৩-৮৪। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মাত্রই ভর্তি হয়েছি এবং মহানন্দে ক্যাম্পাসে বিচরণ করছি। অবশ্য আমাদের সেই আনন্দে ভাটা পড়তেও সময় লাগেনি। শবব্যবচ্ছেদ কক্ষে—মানে লাশকাটা ঘরে মানবদেহের গঠনতন্ত্র, গতিবিধি নির্ণয়ে প্রফেসর-প্রভাষকদের তৎপরতায় প্রাথমিক আনন্দটা অনেকখানিই মিইয়ে এসেছিল। আমাদের সেই ম্রিয়মাণ চেতনায় অনেকখানি ধনাত্মক অনুঘটকের কাজটি যিনি করেছিলেন, তিনি প্রফেসর ডা. শুভাগত চৌধুরী। বায়োকেমিস্ট্রি-জৈব রসায়ন বিষয়ের একজন একনিষ্ঠ অধ্যাপক।
বুঝি, না বুঝি দারুণ একটা বিষয়ে যে আলোকপাত করা হচ্ছে ডায়াসে—এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছিলাম সেই প্রথম দিনেই তাঁর ক্লাসে। স্যার বলে যাচ্ছেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাই শুনে যাচ্ছি। সমস্ত ক্লাসে পিনড্রপ সাইলেন্স। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করতেন তিনি। আমরা তখনো সাইলেন্ট! তিনি জানতে চাইতেন, কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কি না? আমরা তবুও সাইলেন্ট! তিনি তখন বলতেন, যদি তোমরা প্রশ্ন না করো, তাহলে আমাকেই প্রশ্ন করতে হবে। সে এক মহা ভাবনার বিষয়ই হয়ে উঠেছিল! তবে তার মধ্যে একধরনের তাগিদও ছিল। জীবের জৈব রসায়নে আগ্রহ থাকবে না? সমস্যাটা যা ছিল, ইংরেজি ভাষাটা বাংলায় তরজমা করে করে আত্মস্থ করতে হতো। তার মানে শ্রমসাপেক্ষ। এ বিষয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এক–দুজন পুরো ক্লাসের মুখরক্ষা করত। সামনের সারিতে বসা সাবিনের এ বিষয়ে জুড়ি ছিল না। ব্রিটিশ একসেন্টে প্রশ্ন যখন করতেন স্যার, অনেকটা সেরকম করেই উত্তর দিতে পারত সাবিন।
পরে এমন হলো—ক্লাসে আমরা যাই ঠিকই, খুব ভোরে উঠে ৮টার মধ্যে বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাসে উপস্থিত হই শুভাগত স্যারের মুখে গলগল ব্রিটিশ ইংরেজি শুনতে। আর আমাদের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠে সাবিন! তবে সবচেয়ে যা স্বস্তির ছিল, পড়া না পারলে তিনি তেমন মাইন্ড করতেন না। বরং হাসিমুখে এটা সেটা মজার কথা শোনাতেন। স্যারের মুখে তখন যে বাংলা শোনা যেত, তা একেবারেই যেন তাঁর জন্মস্থানের ছাপে মোড়া। সিলেট অঞ্চলের বাচনশৈলী ফুটে উঠত তাঁর প্রকাশে। আশ্চর্য হয়ে যেতাম, এই মানুষটিই কিনা খানিক আগে ওই রকম সাহেবি ভাষায় অনর্গল পাঠ দিয়েছেন আমাদের!
একদল ছেলে তো ছিলই সকাল সকাল আইল্যান্ডে বসে থেকে লেডিস হোস্টেল থেকে মেয়েদের কলেজযাত্রার পুরো সময়টা পার করে তবে ক্লাসে ঢুকত। স্যার কিন্তু খুব একটা ভর্ৎসনা তাদের করেননি কখনো। বরং এমনই কোনো একটা উদ্ধৃতি ছুড়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি যে পুরো ক্লাসে একযোগে আমরা হেসে উঠেছি। তবে বেশি দিন আর ছেলেরা বিষয়টি কন্টিনিউ করেনি। মানে চেষ্টায় থেকেছে অন্তত শুভাগত স্যারের ক্লাসে সময়মতো হাজির হতে। স্যারের মুহুর্মুহু ইংরেজি ভাষণের মাঝখানে হঠাৎই দুজন যখন পেছনের দরজা দিয়ে ক্লাসে ঢুকেছে, পাঠ বন্ধ করে স্যার খানিক দাঁড়িয়েছেন। তারপরই হয়তো বলে উঠেছেন, ‘...অনেক দিন পরে যেন বৃষ্টি এল!’ তবে এর পর থেকে তিনি খেয়ালে রেখেছেন পড়ুয়াদের হাজিরার বিষয়ে।
আগাগোড়া পরিশীলিত সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন প্রফেসর শুভাগত চৌধুরী। লেডিস হোস্টেলে আমাদের যে মাসিক ফিস্ট হতো, স্যারকে আমন্ত্রণ করা হতো। তিনি আসতেন। স্বতঃস্ফূর্ত অংশও নিতেন। মনে আছে, আমাদের অনুরোধে একবার গানও শুনিয়েছিলেন তিনি—
‘...মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে...
সেইদিন ভরা সাঝে... ’।
মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়েছি কত বছর-যুগ হয়ে গেল! পত্রিকাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–সংবলিত স্যারের স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা পড়াটা একসময় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ বড় আনন্দের যে এ রকম একজন গুণী মানুষকে সম্মানিত করেছে বাংলা একাডেমি।
রোগপ্রতিরোধ বিষয়ে একটা যে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, স্যার সেখানে সক্রিয় ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম সেদিন কথার মাঝেই। স্যারের অভিব্যক্তিতে বুঝতে অসুবিধে হলো না, জনমানুষের কল্যাণে গৃহীত এ রকম একটি উদ্যোগ পারস্পরিক আন্তরিকতার অভাবে এগোতে পারেনি! এ নিয়ে তাঁর মনে কষ্ট ছিল।
স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই! তাঁর কর্ম এবং চেতনাবোধ নিয়ে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি, তবে তা হবে প্রফেসর ডা. শুভাগত চৌধুরীর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন।
ডা. তৃপ্তি বালা
সাবেক পরিচালক
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, ঢাকা।