আবেদ ভাইয়ের স্মিত হাসির আহ্বান

স্যার ফজলে হাসান আবেদ

প্রচলিত যে কোনো মানদণ্ডেই ফজলে হাসান আবেদ সফল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন। দু বছর আগে এই দিনে তিনি যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তার বহুমুখী অর্জনের জন্য তখন তিনি দেশে-বিদেশে, তৃণমূল থেকে উপরি-কাঠামোতে সর্বত্র স্বীকৃতি, প্রশংসা ও শ্রদ্ধার জোয়ারে ভেসেছিলেন। সত্যিকার অর্থে এটি তার প্রাপ্য ছিল। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আবেদ ভাই এর বহুমাত্রিক অর্জনের সুদীর্ঘ তালিকা এতই সুপরিচিত যে তা পুনর্ব্যক্ত করার প্রয়োজন করে না। কিন্তু যেই স্বীকৃতি আরও বেশি নজর কাড়ার মতো ছিল ব্র্যাকের আনুষ্ঠানিক পরিমণ্ডলের বাইরে তা ছিল সাধারণ মানুষের পর্যায়ে।

আমি পরিচিত-অপরিচিত অনেক তৃণমূলের মানুষকে এভাবে বলতে শুনেছি-‘একজন ভালো মানুষ চলে গেলেন যে সব সময় সাধারণ মানুষের ভালো করার কাজে মনোযোগী ছিলেন’। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আবেদ ভাই এর এই ‘নিয়ত’ এর জায়গাটিই অধিক প্রণিধানযোগ্য। ‘নিয়ত’ ধারণাটির প্রচলন উন্নয়ন আলোচনায় তেমন নেই। ধারণাটি উন্নয়নের টেকনোক্রেটিক চিন্তাধারার সঙ্গে যায় না। বরং যেই প্রতিপাদ্যগুলোকে ‘নিয়ত’ আলোকপাত করে তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা, মনোবাসনা, ব্রত। আবেদ ভাই এর লিগেসিকে তাই আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই সফল প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সফল উন্নয়ন কৌশল উদ্ভাবন আবেদ ভাই এর অন্যতম অর্জন। কিন্তু যে আদি কথাটি আরও অধিকতর স্মরণযোগ্য তা হচ্ছে এই ‘নিয়ত’ এর কথাটিই যার শুরু ৭০ এর জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড ভোলার আক্রান্ত জনপদে। পরবর্তী পাঁচ দশকের নিরলস সাধনাই ছিল ভাগ্যবিড়ম্বিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে এই ব্রতকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই আবেদ ভাই এর দ্বিতীয় প্রয়াণ দিনে তার অর্জনের কথায় সীমাবদ্ধ না রেখে তার সাধনার ওপর নজর দেওয়াও জরুরি।

আবেদ ভাই খুবই গুরুত্ব দিতেন মাঠ থেকে শোনার। যার ভাগ্য উন্নয়নের বিষয়, তার কথা না শুনে কীভাবে উন্নয়ন আগাতে পারে? এই মৌলিক বিষয়টি নিয়ে আবেদ ভাই সর্বদা সজাগ ছিলেন। আবেদ ভাই থেকে এই শিক্ষার বিষয়টি এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ সময় বদলাচ্ছে। নূতন চ্যালেঞ্জ সামনে চলে এসেছে-যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, নিরাপদ খাদ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, যুব/কিশোর-কিশোরী এজেন্ডা ইত্যাদি।

এই উপলব্ধি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারিতায় আরও উজ্জ্বল হয়ে আছে যখন ২০১৯ এর মাঝামাঝি আবেদ ভাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ডায়াগনোসিস পেলেন। সার্জারির মাধ্যমে জীবন কিছুটা প্রলম্বিত করার একটি সম্ভাবনা থাকলেও অসম্ভব দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আবেদ ভাই তার শেষ অধ্যায় রচনা করলেন। ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের এই নিদারুণ মুহূর্তেও আবেদ ভাই প্রাধান্য দিলেন তার ব্রতকে, নিজেকে নয়। শুধু প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার বিষয়টি নয়, প্রাধান্য দিলেন প্রতিষ্ঠানের ‘সেন্স অব মিশন’কে প্রজ্বলিত করতে। বাংলাদেশে, বিশ্বের।

প্রতিষ্ঠান গড়াই বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কার্যকর প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান, নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এ কাজটিই আবেদ ভাই করে গেছেন। তার ছিল ‘হ্যান্ডস অন অ্যাপ্রোচ’। সব কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বিক নজর রাখতেন। কিন্তু এই নজর প্রতিষ্ঠানের বিকাশের প্রয়োজনে নিছক খবরদারির জন্য নয়। সাশ্রয়ী বিকাশ, মেধা-ভিত্তিক বিকাশ। প্রতিষ্ঠানই কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কল্যাণকর ফলাফলের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করা। উন্নয়নও কিন্তু জোর-জবরদস্তির ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। আবেদ ভাই খুবই গুরুত্ব দিতেন মাঠ থেকে শোনার। যার ভাগ্য উন্নয়নের বিষয়, তার কথা না শুনে কীভাবে উন্নয়ন আগাতে পারে? এই মৌলিক বিষয়টি নিয়ে আবেদ ভাই সর্বদা সজাগ ছিলেন। আবেদ ভাই থেকে এই শিক্ষার বিষয়টি এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ সময় বদলাচ্ছে। নূতন চ্যালেঞ্জ সামনে চলে এসেছে-যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, নিরাপদ খাদ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, যুব/কিশোর-কিশোরী এজেন্ডা ইত্যাদি। শোনার সংস্কৃতি জোরদার করেই নূতন সমাধানের অন্বেষণ করতে হবে। এটিই আবেদ ভাই এর শিক্ষা।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আবেদ ভাই এর অবদানের স্বীকৃতি প্রকারান্তরে সামাজিক ও বেসরকারি খাতের অবদানের স্বীকৃতি। গত পঞ্চাশ বছরে এই ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আগামীর অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করতেও সামাজিক ও বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকা রাখার সহায়ক পরিবেশ অব্যাহত রাখা সমপরিমাণ জরুরি। সামাজিক ও বেসরকারি উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পরিপূরক। যখনই এই সমগ্র সমাজ তথা ‘হোল-সোসাইটি’ অ্যাপ্রোচ কার্যকর হয়েছে তখনই সুষম উন্নয়ন বেগবান হয়েছে। আবেদ ভাই এর অর্ধ শতাব্দীর নিরলস সাধনা এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছে।

আবেদ ভাই যখন ২০১৯ এর জুলাইতে ব্র্যাক বাংলাদেশ বোর্ডের চেয়ারপারসন পদে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রথমে বিস্মিত হয়ে পরে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমার ওই পদে করণীয় সম্বন্ধে তার কোনো বিস্তারিত পরামর্শ আছে কিনা। তিনি আসলে ওই উত্তর পথে হাঁটেননি। আমি নিজ থেকে পরে বুঝলাম যে ওনার ‘মেসেজ’ অন্য ধরনের। উনি আস্থা রাখছেন যাদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তারা তাদের সময়ের প্রেক্ষিতে ও সম্মিলিত বুদ্ধিতে ‘করণীয়’ চিহ্নিত করবে। তিনি বরং গুরুত্ব দিলেন ‘করণীয়’ তালিকা তৈরির চেয়ে ব্রত, নিয়ত, ‘সেন্স অব মিশন’ প্রজ্বলিত করতে। ওপার থেকে তার স্মিত হাসি তাই ভরসা দিচ্ছে ও আহ্বান জানাচ্ছে সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও শ্রম আঁকড়ে ধরে বহুদূর যাওয়া যায়, যেতে হবে। কারণ অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশে ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পবিত্র কাজ কাঁধে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব আজকের প্রজন্মেরই।

শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করছি।

হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ।