‘আমরা এত দিনে হত্যাকে মৃত্যু ভাবতে শিখে গেছি’

কাজী মসিউর রহমান
ছবি : সংগৃহীত

‘জয় বাংলা’ চত্বর থেকে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের দিকে ধীরপায়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ থামতে বাধ্য হলাম। ভীষণ মায়াময় একটি কণ্ঠস্বর স্পর্শ করল। দূরে মাঠের এক কোনায় খেজুর গাছতলায় একজন ব্যক্তিই ঝরাচ্ছিলেন সেই মাধুর্য। সামনে বেশ কজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন সেসব। লোকটির সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল অসম্ভব। চিন্তা ও মননে ছিল দূরদর্শিতার ছাপ। তিনি ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর সমাজে আশার কথা শোনাতেন। পরিবর্তনের কথা শোনাতেন। বলছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মসিউর রহমানের কথা, যিনি ১৩ অক্টোবর পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত ব্যবস্থাপনার বাইরে গিয়েও শিক্ষার্থীদের আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতেন। কেননা, উদ্ভাবনের সবচেয়ে গভীরে রয়েছে প্রশ্ন করার সামর্থ্য। আলোকিত মানুষ গঠনে কাজ করেছেন নীরবে-নিভৃতে। গঠন করেছেন ‘চেরাগ: একটি জনঅধ্যয়ন কেন্দ্র’ নামে গণপাঠাগার। তিনি বলতেন, পাঠাগার গড়তে শুরুতে একটা ট্রাংক আর ২০টি বই-ই যথেষ্ট। লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতো তিনিও মনে করতেন, ‘লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড। কারণ, বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব।’ এ জন্য লাইব্রেরি সৃষ্টিতে তাগাদা দিতেন তিনি। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেন উদারভাবে চিন্তা করতে। প্রথাগত, সনাতন বলয় ভেঙে নতুন করে ভাবতে।

এমন মৃত্যু আমাদের জন্য, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। একজন মসিউর রহমান গড়ে ওঠার পথ অতটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এমন প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, গতি আর সম্মোহনী ক্ষমতার মিশেল সমাজে কম মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এমন ব্যক্তি অনুকরণীয় হন সহকর্মীদের, অনুসরণীয় হন শিক্ষার্থীসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনবোধে। নিখাদ ষোলো আনাই বাঙালিয়ানার ছাপ দৃশ্যমান ছিল মসিউর রহমানের মধ্যে। বাংলায় উচ্চশিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রাণান্ত চেষ্টার কমতি ছিল না। বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা, সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম মমতা, এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনে তিনি ছিলেন অনন্য। প্রকৃতির প্রতি তাঁর আত্মিক টান ছিল বিস্ময়কর।

মধুমতীর তীরে বা বিশ্ববিদ্যালয় লেকের পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে যেতেন আড্ডায়, সমসাময়িক বিষয়ে মুক্ত আলোচনা কিংবা সুস্থ বিতর্কে। শিক্ষার্থীদের বোধের বিকাশে পরামর্শ দিতেন উদারবাদী হতে, সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে কাজ করেছেন পরিবেশবিষয়ক ও স্বেচ্ছাসেবী নানান সংগঠনের সঙ্গে। মানবিক মানুষ গঠনে আপ্রাণ শ্রম দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে তর্কের খাতিরে সহকর্মীদের প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘মানবিক না হলে শিক্ষাটা কি পরিপূর্ণ হয়?’

একুশে ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি ভবনের সামনে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ‘কাজী মসিউর রহমান স্মৃতিস্তম্ভ’-এর মাধ্যমে আলোকিত এই মানুষটাকে চিরকাল আগলে রাখবে তাঁর শিষ্যরা। প্রিয় গুরুর প্রয়াণে শিষ্যরা যতটা শোকাহত, তার চেয়ে বেশি হতাশ ঘাতক চালক আইনের আওতার বাইরে থাকাতে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এমন অকালপ্রয়াণ যতটা বেদনাদায়ক, বিচারহীন সংস্কৃতি বা ধীর গতি তার চেয়ে বেশি হতাশাজনক। মসিউর রহমান নিজেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আক্ষেপ করে এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘তুমি কাঁদছ যে! চেয়ে দেখো, আমরা এত দিনে হত্যাকে মৃত্যু ভাবতে শিখে গেছি।’

মসিউর রহমানের এক সহকর্মী তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সবাই চাকরিতে ঢোকেন। একটি পদ। কিছু লেকচার। মাস শেষে মাইনে। চাকরিই তো! কিন্তু সাধনার মাধ্যমে কেউ কেউ শিক্ষক হন। কীভাবে বুঝবেন? যখন ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কারও কাছ থেকে কিছু বুঝে নেয়। শিক্ষক সদাহাস্যে বুঝিয়ে দিতে পারলে তৃপ্তি পান। তখন তিনি শিক্ষক হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে একজন আদর্শ শিক্ষককে হারাল। শিক্ষকেরা হারালেন অধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রামী এক অকুতোভয় সহকর্মীকে, অকৃত্রিম এক বন্ধুকে, যিনি কোনো দিন আপস করেননি। শিক্ষার্থীরা হারাল সত্যিকারের একটি মহৎপ্রাণ বন্ধু।’

২০১৪ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ঝামেলা হলে কিছু শিক্ষার্থী কারান্তরীণ হয়। মসিউর রহমান তাঁর শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে এমন অবস্থানে ভীষণ মর্মাহত হন। তিনি প্রায়ই কারাগারে দেখা করতে যেতেন তাদের সঙ্গে। অভয় ও সাহস জোগাতেন।

লিঙ্গসমতার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন বেশ সজাগ। যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মসিউর রহমানকে ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়, তখন তিনি নিজেকে ছাত্র উপদেষ্টা না বলে শিক্ষার্থী উপদেষ্টা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর। একের পর এক সংগঠন অনুমোদনের আবেদন পড়তে থাকল শিক্ষার্থী উপদেষ্টার দপ্তরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোর নিবন্ধনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং বহুত্ববাদ, লৈঙ্গিক সমতা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা; এমন সব শর্ত ঠিক করে দেন তিনি।

সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা হাতেকলমে শেখাতেন। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে যে বৃহৎ জগৎ আছে, সেটা উপলব্ধি করবার জন্য সাহিত্যের প্রেমে পড়তে বলতেন। শিক্ষকতার মহান জ্যোতির্বলয়ে যেটুকু পথ পাড়ি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক মানুষ। নিজের বিভাগ ছাপিয়ে হয়ে উঠেছিলেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের, সব শিক্ষার্থীর শিক্ষক।

আজ তিনি এই ধরণির অতীত। তবু তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মণিকোঠায় চিরসবুজ, অম্লান। একুশে ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি ভবনের সামনে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ‘কাজী মসিউর রহমান স্মৃতিস্তম্ভ’-এর মাধ্যমে আলোকিত এই মানুষটাকে চিরকাল আগলে রাখবে তাঁর শিষ্যরা। প্রিয় গুরুর প্রয়াণে শিষ্যরা যতটা শোকাহত, তার চেয়ে বেশি হতাশ ঘাতক চালক আইনের আওতার বাইরে থাকাতে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এমন অকালপ্রয়াণ যতটা বেদনাদায়ক, বিচারহীন সংস্কৃতি বা ধীর গতি তার চেয়ে বেশি হতাশাজনক।

মসিউর রহমান নিজেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আক্ষেপ করে এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘তুমি কাঁদছ যে! চেয়ে দেখো, আমরা এত দিনে হত্যাকে মৃত্যু ভাবতে শিখে গেছি।’

মাহমুদুল হাছান শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি।