আমাদের অপ্রস্তুত রেখে চলে গেলেন মিজান

মিজানুর রহমান খান (১৯৬৭–২০২১)
ছবি: খালেদ সরকার


মৃত্যুর অনিবার্যতা অনস্বীকার্য, কিন্তু অপঘাতে, অপরিণত বয়সে এবং অসময়ে মৃত্যু আমাদের সবাইকে পীড়িত করে। যখন প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদ পাই, আমার চেয়েও কনিষ্ঠজনের জীবনাবসানের হৃদয়বিদারক সংবাদ শুনতে হয়, তখন আমার মনে হয় জন ডানের কবিতার পঙ্‌ক্তি,  ‘যেকোনো মানুষের মৃত্যু আমাকে ছোট করে, কেননা আমি মানবতার অংশ;/ আর তাই জিজ্ঞাসা কোরো না কার জন্য বাজছে ঐ ঘণ্টাধ্বনি, সে বাজছে তোমার জন্য’। যেকোনো মৃত্যুর মধ্যে আমি তাই আমার মৃত্যুর বার্তা শুনতে পাই। প্রবাসী জীবনের আরেক বেদনা হচ্ছে, এসব মৃত্যুসংবাদের ভার একাই বইতে হয়।

মিজানুর রহমান খান, আমার বন্ধুজন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে খবর জানা ছিল, তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির খবর পাচ্ছিলাম প্রতিদিন। কিন্তু তারপরও এই দুঃসংবাদের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। অনিবার্য বলেই কি তার জন্য প্রস্তুত থাকা যায়? যায় না, আমরা বারবার তা বুঝি। বন্ধু মিজানের অনন্তযাত্রা আবার আমাকে-আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমি চার্চের ঘণ্টাধ্বনির মতো কোথায় যেন একটা ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। এমন এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আমরা জীবন যাপন করছি, যখন কান পাতলেই এই ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ধ্বনি আরও জোরে বাজছে।  

মিজান আমাদের অপ্রস্তুত রেখে চলে গেলেন, এটাও আসলে বিস্ময়কর নয়—তাঁর সংবাদভাষ্য, উপসম্পাদকীয়, সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন, এগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের অপ্রস্তুত করেই এসেছে। মিজান আমাদের অপ্রস্তুত করতেন, কিন্তু আহত করেননি, আমাদের ভেতরে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। মিজান সাংবাদিকতায় যে বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন সেটা হচ্ছে আইন, বিচার বিভাগ, সংবিধান। ভালো করে বিবেচনা করে দেখতে চেয়েছি, এভাবে এ বিষয়ে কতজন সাংবাদিক মনোযোগ দিয়েছেন? যাঁরা কেবল আইনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিংবা পেশার কারণে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত, তার বাইরে কতজন এভাবে বুঝতে এবং বোঝাতে চেয়েছেন? প্রচলিত উত্তর হবে, হাতে গোনা। আসলেই কি হাতে গোনা? মিজানুর রহমান এ ক্ষেত্রে অনন্য। মিজান আমার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ, বন্ধুজন সেই অর্থে আমার একটা পক্ষপাতিত্ব আছে; কিন্তু পক্ষপাতহীনভাবে ভেবেও আমি তাঁর মতো কাউকে পাই না। আমরা অপ্রস্তুত ছিলাম আইন, বিচার, সংবিধান নিয়ে এইভাবে লেখা যায়, লেখা দরকার। মিজান আমাদের জন্য এগুলোকে স্বস্তিদায়ক করে তুলেছেন।

মিজান তাঁর লেখায় সেই দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন, যেগুলো নিয়ে আমরা প্রায়ই অস্বস্তি বোধ করেছি, কেননা আইনের, সংবিধানের এসব বিষয়কে হয় জটিল নতুবা স্পর্শকাতর বলে বিবেচনা করেছি। কিন্তু মিজান সেগুলো নিয়েই লিখেছেন, কথা বলেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা সব সময় স্বস্তিকর হয়েছে, তা নয়। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা প্রায়ই বলেন যে কাজপাগল মিজান এলোমেলো। এলোমেলো কিন্তু তিনি তাঁর লেখায় বারবার বোঝাতে চেয়েছেন আইনের শাসনের কোথায় ব্যত্যয় হচ্ছে, কী করে সংবিধান উপেক্ষা করা হচ্ছে, সেখানে তিনি নিষ্কম্প। তাঁর সঙ্গে সব সময় একমত হওয়ার দরকার হয়নি, সম্ভবও হয়নি। নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নকে সামনে রেখেই তিনি তাঁর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। তাঁর ব্যাখ্যার সঙ্গে যাঁরা একমত হননি তাঁরাও জানেন মিজানের ব্যাখ্যাকে আমলে নিতে হবে।

মিজানের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে, ঢাকায়, প্রথম আলোর সূত্রে। যত দূর মনে পড়ে, মিজান আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন। আমি তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। প্রথম দেখায় আমাদের আলোচনা সাক্ষাৎকারের সীমায় আটকে থাকেনি, সাক্ষাৎকার নিতে মিজানকে আরেক দিন আসতে হয়েছিল। সেই থেকে আমাদের যোগযোগ।

মিজান তাঁর লেখায় সেই দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন, যেগুলো নিয়ে আমরা প্রায়ই অস্বস্তি বোধ করেছি, কেননা আইনের, সংবিধানের এসব বিষয়কে হয় জটিল নতুবা স্পর্শকাতর বলে বিবেচনা করেছি। কিন্তু মিজান সেগুলো নিয়েই লিখেছেন, কথা বলেছেন।

আইন, বিচার এবং সংবিধান আগ্রহের প্রধান বিষয় হলেও এর বাইরেরও মিজানের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিল দস্তাবেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের আর্কাইভে এসে স্বল্প সময়ের গবেষণায় তিনি যা উদ্ধার করেছেন, তা অনেক গবেষক হয়তো দীর্ঘ সময়েও খুঁজে পেতেন না। এই নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ঘটনাপ্রবাহ বিষয়ে তাঁর দলিলনির্ভর প্রতিবেদন; সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনীতিকদের ভাষ্যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিষয়ে তাঁর প্রতিবেদন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে সাহায্য করবে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

মিজানের সঙ্গে আমার এসব বিষয়ে কথা হয়েছে প্রায়ই। তাঁর গ্রন্থগুলো আরও বেশি সাহায্য করত, যদি সেগুলো একাডেমিক গবেষণা ফলাফল ডকুমেন্টশনের পদ্ধতি অনুসরণ করত। মিজানকে এসব বললে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিতে হালকা করে ফেলতেন। কিন্তু একাধিকবার মিজান সেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি ভেবেছি এখনো সময় অনেক বাকি আছে। মিজান গুছিয়ে নিয়ে এগুলোর দিকে নজর দেবেন। কিন্তু কাজপাগল মিজানের সেই সময় হলো না; ৫৪ বছর খুব কম সময়, মিজানের জন্য তো অবশ্যই।

২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকে প্রথম আলোতে আমার নিয়মিত লেখার সূচনা। মতি ভাইয়ের অনুরোধে শুরু, কিন্তু অস্বীকার করি কী করে যে মিজানের উপর্যুপরি অনুরোধই এটা সম্ভব করেছিল? তিনিই ছিলেন প্রথম আলোতে আমার প্রতিদিনের যোগসূত্র। সেই থেকে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ। আইন-বিচার-সংবিধান বিষয়ে তথ্য বা ব্যাখ্যার দরকার হলে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি। মিজান অনেক সময় আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। তাঁর লেখার সঙ্গে ভিন্নমত থাকলে জানিয়েছি, কিন্তু আমার কঠোর সমালোচনা সত্ত্বেও মিজান কখনোই আমার ওপর ক্ষুব্ধ হননি, উপরন্তু হাসিমুখেই এগুলো সহ্য করেছেন।

আমি ঢাকায় গেলে যে বোনের বাড়িতে থাকি সেখানে মিজান আসেন; বোনকে বলি, ‘মিজান আসবে; চিনতে পেরেছেন?’ মিজানকে আমার বোন চেনেন প্রথম আলোর লেখক আর টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গুরুগম্ভীর বিষয়ের আলোচক হিসেবে; আমার বন্ধু হিসেবেও। আমি বলি, ‘ওই যে মিজান, উচ্চ স্বরে কথা বলে।’ মিজান উচ্চ স্বরে কথা বলতেন, কিন্তু তাঁর বিনয় এবং অপরের প্রতি, অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।

উচ্চ স্বরে কথা না বললে মিজানকে মানাত না। তাঁর হাসি ছিল সংক্রামক। অনেকবার মিজানকে বলেছি, ‘আপনার ওপরে তো আমি রাগ করেছি।’ মিজানের ওপর এর চেয়ে বেশি রাগ করা সম্ভব বলে আমার কখনোই মনে হয়নি। মিজান হেসে দিয়ে বলতেন, ‘কেন রীয়াজ ভাই?’ মিজানের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে কিছু তথ্যের দরকার ছিল, তদুপরি মিজানের পুরোনো কিছু প্রতিবেদন। যথারীতি আমাদের কথা কেবল সেই প্রসঙ্গেই সীমিত থাকেনি। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ই-মেইলে পাঠিয়েছিলেন মিজান, ১৩ নভেম্বর। তারপর আর কথা হয়নি। কোনো দিন কথা হবে না।

বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতার পঙ্‌ক্তি - ‘“ভুলিবো না”—এত বড় স্পর্ধিত শপথে/ জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক’। জীবনের এত আয়োজন, ব্যস্ততার এত উপকরণ চারদিকে, জীবনের স্বাভাবিকতা এতটাই নির্মম যে আমার প্রিয়জনকে বিস্মৃত হই, বন্ধুদের বিস্মৃত হই—আজ অথবা কাল। কিন্তু আজকে, অন্তত আজকে মিজানকে বলি,‘ভুলিবো না’।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।